কিন্তু ফারাওদের দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই। প্রায় সব দেশেই মানুষ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে বলেছে, এই ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি আর এগিয়ে যাবার প্রয়োজন নেই। যা সঞ্চয় করেছি তাই বেঁচে থাকুক, সেইটেই অপরিবর্তনীয় হয়ে থাক। ফলে হয়েছে পতন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন এই বিষয় নিয়ে তাজমহলের মতো কবিতা লিখেছেন তখন আমার আর বাক্যব্যয় কী প্রয়োজন?
.
১৯.
চাঁদের আলোতে বিশ্বজন তাজমহল দেখবার জন্য জড়ো হয়।
পিরামিডের বেলাও তাই।
চতুর্দিকে লোকজন গিগি করছে। এদেশের মেলাতেও বোধ করি এত ভিড় হয় না।
অবশ্য তার কারণও আছে। নিতান্ত শীতকাল ছাড়া গরমের দেশে দিনের বেলা কোনও জিনিস অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে দেখা যায় না। বিশেষ করে যেখানে কোনও সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখবার বালাই নেই সেখানে তো আরও ভালো। তাজের মিহি কাজ চাঁদের আলোতে চোখে পড়ে না, তবু সবসুদ্ধ মিলিয়ে তার যে অপূর্ব সামঞ্জস্য চাঁদের আলোতে ধরা দেয় দিনের কড়া আলোতে সেটা দর্শককে ফাঁকি দেয় বলে মানুষ চাঁদের আলোতে তাজ দেখে। পিরামিডে সেরকম কোনও নৈপুণ্য নেই, তদপুরি পিরামিডের চতুর্দিকে মরুভূমি বলে সেখানে দিনের বেলাকার গরম পীড়াদায়ক, কাজেই নিতান্ত শীতকাল ছাড়া দিনের বেলা কম লোকই পিরামিড দেখতে যায়।
পক্ষান্তরে শীতের দেশে ব্যবস্থা অন্যরকম। আমি ফটফটে চাঁদের আলোতে কোন গির্জার পাশ দিয়ে শীতের রাতে হি-হি করে বহুবার বাড়ি ফিরেছি। কাক-কোকিল দেখতে পাইনি।
পল-পার্সি আর আমাদের দলের আরও কয়েকজন পিরামিডের মাঝখানকার কবর-গৃহ দেখতে গেছেন। আমি যাইনি।
আমি বসে বসে শুনছি জাত-বেজাতের কিচিরমিচির, স্যান্ডউইচ খোলার সময় কাগজের মড়মড়, সোডা-লেমনেড খোলার ফটাফট। ইয়োরোপীয়েরা খাবার ব্যবস্থা সঙ্গে না নিয়ে তিন পা চলতে পারে না। পিরামিড হোক আর নিমতলাই হোক, মোকামে পৌঁছানো মাত্রই বলবে, টম, বাস্কেটটা এই দিকে দাও তো। ডিক, তুমি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালো আর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ডার্লিং, আপেলগুলো ভুলে যাওনি তো? ইতোমধ্যে হ্যারি হয়তো গ্রামোফোনের জাতা চালিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য যদি দলে মেয়েরা ভারি হন তবে কোনওকিছুই শুনতে পাওয়া যায় না। লাভলি, গ্র্যান্ড, সবলাইম ইত্যাদি শব্দে তখন যে ঘ্যাট তৈরি হয় তার কোনটা কী, ঠিক ঠাহর করা যায় না।
কোনও কোনও টুরিস্ট আমাকে বলেছেন, নায়াগ্রার গম্ভীর জলনির্ঘোষ শুনতে হলে নাকি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যেতে নেই। যে ধ্বনি তাদের ভিতর ওঠে তাতে নাকি নায়াগ্রার থাক, মেয়েরা আমার ওপর এমনিতেই চটে আছেন। কিন্তু আমার ওপর চটে আর লাভ কী? ওয়াদের খাস-পেয়ারা কবি রবিঠাকুরই এ বাবদে কী বলেছেন
ছেলেরা ধরিল পাঠ, বুড়ারা তামুক,
এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ।
পল-পার্সি ফিরে এসেছে। আমি শুধালুম, কী দেখলে, বাছারা? তার পর নোটবুক খুলে বললুম, গুছিয়ে বল, সবকিছু টুকে নেব; আমি তো বে-আক্কেলের মতো এই এখানে বসে বসে সময় কাটালুম।
পার্সি করুণ কণ্ঠে বললে, আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না স্যর। দেখেছি কচু-পোড়া। মশালের আলোতে হাতের তেলো চোখে পড়ে না। তারই জোরে বিস্তর সুড়ঙ্গ পেরিয়ে একটা চৌকো ঘরে শেষটায় পৌঁছলুম। বেবাক ভোঁ ভো। এক কোণে একখানা ভাঙা ঝটা পর্যন্ত নেই! গাইড বললে, ব্যস্ ফিরে চলুন। আপনি তখনই বারণ করলেন না কেন?
আমি বললুম, বারণ করলে কি শুনতে? বাকি জীবন মনটা খুঁত খুঁত করত না, ফারাওয়ের শেষ শোওয়ার ঘর দেখা হল না? এ হল দিল্লির লাড্ডু।
শুধাল, সে আবার কী?
আমি বুঝিয়ে বললুম।
পল বললে, গাইড বলছিল, পিরামিডের যে বিরাট বিরাট পাথর সেগুলো নাকি টেনে টেনে নদীর ওপার থেকে এখানে আনা হয়েছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না ওর যা ইংরেজি!
আমি বললুম, ঠিকই বলেছে! নীলের এপারে পাথর পাওয়া যায় না। তাই ওপার থেকে পাথর কেটে ভেলায় করে এপারে নিয়ে আসা হত। আর সে যুগে মানুষ চাকা কী করে বানাতে হয় জানত না বলে সেই পাথরগুলো ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেত। কাঠ বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত পিছলে নিয়ে যাবার সুবিধের জন্য। এবং শুনেছি, সে পথে নাকি ঘড়া ঘড়া তেল ঢালা হত, সেটাকে পিছলে করার জন্য। আশ্চর্য নয়! এর ছ-টা পাথরে যখন একটা এঞ্জিনের আকার ধরতে পারে, এবং স্পষ্ট দেখেছি, এঞ্জিন রেললাইন থেকে কাত হয়ে পড়ে গেলে তাকে খাড়া করবার জন্য আজকের দিনের কপিকল পর্যন্ত কীরকম হিমসিম খায়, তখন তো তেল-ঘি ঢালার কথা আর অবিশ্বাস করা যায় না।
তখন আলোচনা আরম্ভ হল চাকা আবিষ্কার নিয়ে। আগুন যেরকম মানুষকে সভ্যতার পথ দেখিয়ে দিল চাকাও মানুষকে ঠিক তেমনি বাকি পথটুকু অক্লেশে চলতে শেখাল। শুনেছি, ভারতের মোন-জো-দছড়াতে প্রথম চাকা আবিষ্কার হয় এবং ক্রমে ক্রমে সেটা সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা এখনও যখন পাল্কি চড়ি তখন বোধহয় আদিম যুগে ফিরে যাই, যখন মানুষ চাকা আবিষ্কার করতে শেখেনি। ছ জন বেয়ারা একটি মেয়েকে বইতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে যায়, ঘড়ি ঘড়ি জিরোয় আর গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খায়; ওদিকে একজন রিকশাওলা দুটো লাশকে দিব্যি টেনে নিয়ে যায়– সবই চাকার কল্যাণে।
আবুল আসফিয়া বললেন, চাকা এরা আবিষ্কার করতে পারেনি সত্য, কিন্তু হাতের নৈপুণ্যে এরা আর সবাইকে হার মানিয়েছে। এই যে হাজার হাজার টনী লক্ষ লক্ষ পাথর একটার গায়ে আরেকটা জোড়া দিয়েছে, সেখানে এক ইঞ্চির হাজার ভাগের একভাগের ফাঁক। আজকের দিনের জহুরিরা, চশমা বানানেওলারাও এত সূক্ষ্ম কাজ করতে পারে কি না সন্দেহ। আর জহুরিদের কাজ তো এক ইঞ্চি আধ ইঞ্চি মাল নিয়ে। এরা সামলেছে লক্ষ লক্ষ ইঞ্চি।