মিশরের ভিতরে-বাইরে আরও পিরামিড আছে কিন্তু গিজে অঞ্চলের যে তিনটে পিরামিডের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে সেগুলোই ভুবনবিখ্যাত, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম।
রাজা নির্মাণের সময় ভূমিতে দৈর্ঘ্য উচ্চতা
খুফু ৪৭০০ খ্রি. পূ. ৭৫৫ ফুট ৪৮১ ফুট
খাফরা ৪৬০০ ৭০৬ ৪৭১
সেনকাওরা ৪৫৫০ ৩৪৬ ২১০
প্রায় পাঁচশো ফুট উঁচু বললে, না দেখে চট করে পিরামিডের উচ্চতা সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায় না। এমনকি চোখের সামনে দেখেও ধারণা করা যায় না, এরা ঠিক কতখানি উঁচু। চ্যাপ্টা আকারের একটা বিরাট জিনিস আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে পাঁচশো ফুট উঁচু না হয়ে যদি চোঙার মতো একই সাইজ রেখে উঁচু হত তবে স্পষ্ট বোঝা যেত পাঁচশো ফুটের উচ্চতা কতখানি উঁচু।
বোঝা যায় দূরে চলে গেলে। গিজে এবং কাইরো ছেড়ে বহু দূরে চলে যাওয়ার পরও হঠাৎ চোখে পড়ে তিনটে পিরামিড সবকিছু ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আর পিরামিড ছেড়ে যদি সোজা মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাও তবে মনে হবে সাহারার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পরও বুঝি পিরামিড দেখা যাবে।
তাই বোঝা যায়, এ বস্তু তৈরি করতে কেন তেইশ লক্ষ টুকরো পাথরের প্রয়োজন হয়েছিল। টুকরো বলতে একটু কমিয়ে বলা হল কারণ এর চার-পাঁচ টুকরো একত্র করলে একখানা ছোটখাটো এঞ্জিনের সাইজ এবং ওজন হয়। কিংবা বলতে পার ছ ফুট উঁচু এবং তিন ফুট চওড়া করে এই পাথর নিয়ে একটা দেয়াল বানালে সে দেয়াল লম্বায় ছ-শো পঞ্চাশ মাইল হবে। অর্থাৎ সে দেয়াল কলকাতা থেকে দার্জিলিং গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে।
সবচেয়ে বড় পিরামিডটা বানাতে নাকি এক লক্ষ লোকের বিশ বত্সর লেগেছিল।
ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না, সে সম্রাটের কতখানি ঐশ্বর্য আর প্রতাপ ছিল, যিনি আপন রাজধানীর পাশে এক লক্ষ লোককে বিশ বচ্ছর খাওয়াতে-পরাতে পেরেছিলেন। অন্য খরচের কথা বাদ দাও, এই এক লক্ষ লোকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য যে বিরাট প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন সেটা গড়ে তোলা এবং তাকে বিশ বছর ধরে চালু রাখা তারাই করতে পারে যারা সভ্যতার খুব একটা উঁচু স্তরে উঠে গিয়েছে।
এইবারে আমরা পিরামিড নির্মাণের কারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছি।
প্রথম কারণ সকলেরই জানা। ফারাওরা (ম্রাটরা) বিশ্বাস করতেন, তাঁদের শরীর যদি মৃত্যুর পর পচে যায়, কিংবা কোনও প্রকারের আঘাতে ক্ষত হয় তবে তারা পরলোকে অনন্ত জীবন পাবেন না। তাই মৃত্যুর পর তাদের দেহকে মামি বানিয়ে সেটাকে এমন একটা শক্ত পিরামিডের ভিতর রাখা হত যে, তার ভিতরে ঢুকে কেউ যেন মামিকে ছুঁতে পর্যন্ত না পারে। কিন্তু হায়, তাঁদের এ বাসনা পূর্ণ হয়নি। পূর্বেই বলেছি, হাজার হাজার বছর চেষ্টা করে দুষ্ট (অর্থাৎ ডাকাত) এবং শিষ্টেরা (অর্থাৎ পণ্ডিতেরা) শেষ পর্যন্ত তাদের গোপন কবরে ঢুকতে পেরেছেন। তাই করে অবশ্য গৌণত কোনও কোনও ফারাওয়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে– পণ্ডিতেরা তাদের মামি সযত্নে যাদুঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। সেখানে তারা অক্ষত দেহে মহাপ্রলয়ের দিন গুনছেন, যেদিন তারা নব দেহ নব যৌবন ফিরে পেয়ে অমৃতলোকে অনন্ত জীবন আরম্ভ করবেন।
কিন্তু যদি ইতোমধ্যে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায়? ফলে গুটিকয়েক অ্যাটম বম্ পড়ে? তবে?
আমার মনে ভরসা, এঁরা যখন চোর-ডাকু ধনিক-পণ্ডিতদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এত হাজার বৎসর অক্ষত দেহে আছেন, তখন মহাপ্রলয় পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন-ই যাবেন। অ্যাটম বম পড়ার উপক্রম হলে আমি বরঞ্চ তারই একটার গা ঘেঁষে গিয়ে বসব। মামিটা রক্ষাকবচের মতো হয়ে তার দেহকে তো বাঁচাবেই, সেই সঙ্গে আমাকেও বাঁচিয়ে দেবে। চাই কি, গোটা শহরটাই হয়তো বেঁচে যাবে!
পিরামিড নির্মাণের দ্বিতীয় কারণ– এই কারণের উল্লেখ করেই আমি এ অনুচ্ছেদ আরম্ভ করেছি–
ফারাওরা বলতে চেয়েছিলেন সভ্যতার যে স্তরে আমরা এসে পৌঁছেছি, আমরা যে প্রতাপশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছি, সেগুলো যেন এই পিরামিডের মতো অজর অমর এবং বিশেষ করে অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। পরিবর্তন যেন না হয়, যা আছে তাই থাকবে, এই ছিল পিরামিড গড়ার দ্বিতীয় কারণ। পিরামিড জগদ্দল পাথর হয়ে অতি শব্দার্থে জগদ্দল পাথরই বটে- যুগ যুগ ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য, রাজবংশ, ধর্মনীতি সবকিছু, অপরিবর্তনীয় করে চেপে ধরে রাখবে।
তাই পিরামিড দেখে মানুষের মনে জাগে ভয়। আজ যদি সেই ফারাওরা বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর প্রতি জাগত ভীতি। এই পিরামিড যে তৈরি করতে পেরেছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার কল্পনাও তো মানুষ করতে পারে না।
তাজমহলের গীতিরস কঠিন মানুষের পাষাণ হৃদয়কেও গলিয়ে দেয়, কুতুবমিনারের ঋজু দেহ উন্নতশির দুর্বলজনকে সবল হয়ে দাঁড়াতে শেখায়– এই দুই রস কাব্যের, সঙ্গীতের প্রাণ। তাজমহল নিয়ে তাজমহলের মতো কবিতা রচনা করা যায়, কিন্তু পিরামিড নিয়ে কবিতা হয়েছে বলে শুনিনি। বরঞ্চ পিরামিডের দোহাই দিয়ে বেঙ্গল অর্ডিনানুসের অনুকরণে আজ এক নতুন ইজিপশিয়ান অর্ডিনান্স তৈরি করা যায়।
কিন্তু হায়, ফারাওরা অপরিবর্তনের যে অর্ডিনান্স জারি করে বিরাট পিরামিড গড়েছিলেন, সেটা টিকল না। ফারাও বংশ ধ্বংস হল, দূর ইরানের রাজারা মিশর লণ্ডভণ্ড করে দিল, তার পর গ্রিক, রোমান এবং শেষটায় সারা মিশরের লোক ইসলাম গ্রহণ করে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলল। মুসলমানরা দেহ এবং আত্মার পার্থক্য চেনে। অনন্ত জীবন পাওয়ার জন্য দেহটাকে যে মামি করে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই, সেকথা তারা বোঝে।