আমি বে-আক্কেল তাই একবার করেছিলুম। তার কী জরিমানা দিয়েছিলুম শোনো।
ভিয়েনাতে পাশের ঘরে থাকত এক রাশান। সে এসেছিল সেখানে কন্টিনেন্টাল সঙ্গীত শিখতে। ভিয়েনা শহর বেটোফেন মোসার্টের কর্মভূমি– আমাদের যেরকম তানসেন, ত্যাগরাজ, বাঙালির যেরকম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম।
ভিয়েনা ডানয়ুব নদীর পারে। বু ডানয়ুব তোমাদের কেউ কেউ হয়তো শুনেছ।
একদিন সেই রাশান বললে, ডানয়ুব-ফানয়ুব সব আজে-বাজে নদী। এসব নদী থেকে আর কী গান বেরিয়েছে যে পাল্লা দেবে, আমাদের রাশার ভলগা নদী থেকে যে ভলগার মাঝির গান উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে? তুমি গড়-ফড় কী সব মানো, না? আমি মানিনে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতিকে। তারই অন্যতম মধুর প্রকাশ নদীতে। সেই নদীকে আমরা মাধুর্যে হার মানাই ভল্গা মাঝির গান দিয়ে।*[* রবীন্দ্রনাথও এই দম্ভ করেছেন তার বাদল দিনের প্রথম কদমফুল গানে। রেকর্ডে গেয়েছেন, শ্রীযুক্তা রাজেশেরী বাসুদেব।]
বাড়ি ফেরা মাত্রই সে ভলগা-মাঝির রেকর্ড শোনাল। আমি মুগ্ধ হয়ে বললুম, চমৎকার!
কিন্তু ততক্ষণে আমার বাঙাল রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। বাঙালরা অবশ্য জানে, তার অর্থ কী? ঘটি অর্থাৎ পশ্চিম বাঙলার লোক তাই নিয়ে হাসাহাসি করুক। আমার তাতে কোনও খেদ নেই। ওরা তো আমাদের ভাটিয়ালি ভালোবাসে, আমরা তো ওদের বাউল শুনে বাউলে হয়ে যাই।
আমার গরম রক্ত তখন টগবগ করে বলছে, বাঙলা দেশ শত শত নদীর দেশ। রাশাতে আর কটা নদী আছে। তারই একটা ভলগা। সে নদী হারিয়ে দেবে বাঙলা দেশের তাবৎ নদীকে দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
ভাগ্যিস, আব্বাস উদ্দিনের রঙিলা নায়ের মাঝি আমার কাছে ছিল। সেইটে চড়িয়ে দিলুম রাশানের গ্রামোফোনে।
সে চোখ বন্ধ করে শুনল। তার পর বললে– যা বললে তার অর্থ ধাপ্পা।
আমি বললুম, মানে?
সে বললে, সুরটি অতি উচ্চ শ্রেণির এবং তার চেয়েও বেশি কানে ধরা পড়ে ওর অভিনবত্ব। আমি করজোড় স্বীকার করছি, এরকম গীত আমি পূর্বে কখনও শুনিনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলব, এ গীত লোক-গীত নয়। কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও ভূমিতেই গ্রাম্য গীতে এতগুলো নোট লাগে না। তাই বলছিলুম তুমি ধাপ্পা দিচ্ছ।
আমি বললুম, বাছা, ওই হল ভাটিয়ালির বৈশিষ্ট্য। ও যতখানি ওঠা-নামা করে পৃথিবীর আর কোনও লোক-গীত তা করে না।
কিছুতেই স্বীকার করে না ওটা লোকগীত। তার ধারণা ওটা লোকগীত এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাঝখানে উপস্থিত ঝুলছে, আর কয়েক বৎসর যেতে না যেতেই কোনও গুণী সেটাকে উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বরণ করে তুলে নেবেন।
তার পর একদিন সে স্বীকার করলে। বিবিসি-র কল্যাণে। বিবিসি পৃথিবীর লোকগীত শোনাতে শোনাতে ভাটিয়ালি শুনিয়ে বললে এটা পূর্ব বাংলার লোকগীত।
আমি লড়াই জিতলুম কিন্তু তখন থেকেই শুরু হল আমার জরিমানা। আশ্চর্য লাগছে না, যে জিতল সে দেবে জরিমানা? হয়, প্রায়ই হয়। মার্কিনিংরেজ জর্মনি জয় করে বহু বৎসর ধরে সেখানে ঢালছে এবং এখনও ঢালছে বিস্তর টাকা। সেকথা যাক, জরিমানাটা কীভাবে দিতে হল বুঝিয়ে বলি।
এর পর যখনই সে আমাকে সাজা দিতে চাইত তখনই তার বেয়ালাতে বাজাতে আরম্ভ করত ভাটিয়ালির সুর।
বোঝ অবস্থাটা! বিদেশে বিভূঁইয়ে একেই দেশের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে তার ওপর ভাটিয়ালির করুণ টান!
রবীন্দ্রনাথের শ্রীকণ্ঠ বাবুর মতো আমি কাতর রোদনে তাঁকে বেয়ালা বন্ধ করতে অনুনয়-বিনয় করতুম।
কিন্তু আজও বলি, লোকটা যা বেয়ালাতে ভাটিয়ালি চড়াতে পারত তার তুলনা হয় না।
কত দেশ ঘুরলুম, কত লোক দেখলুম, কত অজানা জনের প্রীতি পেলাম, কত জানা জনের দুর্ব্যবহার, হিটলারের মতো বিরাট পুরুষের উত্থান-পতন দেখলুম, সেসব বড় বড় জিনিস প্রায় ভুলে গিয়েছি, কিন্তু এইসব ছোটখাটো জিনিস কিছুতেই ভুলতে পারিনে। মনে হয় যেন আজ সকালের ঘটনা।
চাঁদের আলোতে দেখছি, নীলের উপর দিয়ে চলছে মাঝারি ধরনের ভোলা মহাজনি নৌকা হাওয়াতে কাত হয়ে তেকোনা পাল পেটুক ছেলের মতো পেট ফুলিয়ে দিয়ে। হাওয়া বইছে সামান্যই, কিন্তু এই পেটুক পাল এর-ওর সবার হাওয়াই খাবার যেন কেড়ে নিয়ে পেটটাকে ঢাকের মতো ফুলিয়ে তুলেছে। ভয় হয়, আর সামান্য একটুখানি জোর হাওয়া বইলেই, হয় পালটা এক ঝটকায় চৌচির হয়ে যাবে, নয় নৌকোটা পেছনের ধাক্কা খেয়ে গোটা আড়াই ডিগবাজি খেয়ে নীলের অতলে তলিয়ে যাবে।
এই নীলের জল দিয়ে এ দেশের চাষ হয়। এই নীল তার বুকে ধরে সে চাষের ফসল মিশরের সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেন। তাই এ দেশের কবি গেয়েছেন,
ওগো নীলনদ প্লাবিতা ধরণী আমি ভালোবাসি তোরে,
ওই ভালোবাসা ধর্ম আমার কর্ম আমার ওরে।
.
১৮.
পিরামিড! পিরামিড!! পিরামিড!!!
কোনও প্রকাশের আশ্চর্য প্রকাশ করতে হলে আমরা তিনটে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন–!!!– দিই। তাই কি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনটে পিরামিড কিংবা উল্টোটা? তিনটে পিরামিড ছিল বলে আমরা তিনবার আশ্চর্য হই।
এই পিরামিডগুলো সম্বন্ধে বিশ্বজুড়ে যা গাদা গাদা বই লেখা হয়ে গিয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে গেলেই একখানা আস্ত জলে-ডাঙায় লিখতে হয়। কারণ এই তিনটে পিরামিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো কীর্তিস্তম্ভ যুগ যুগ ধরে মানুষ এদের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্তর জল্পনা-কনা করেছে, দেয়ালে খোদাই এদের লিপি উদ্ধার করে এদের সম্বন্ধে পাকা খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, জান তো, পিরামিডের ঠিক মাঝখানে একটা কুঠুরিতে বিস্তর ধনদৌলত জড়ো করা আছে– তারই পথ অনুসন্ধান করছে পাকা সাড়ে ছ হাজার বছর ধরে। ইরানি, গ্রিক, রোমান, আরব, তুর্কি, ফরাসি, ইংরেজ পরপর সবাই এদেশ জয় করার পর প্রথমেই চেষ্টা করেছে পিরামিডের হাজার হাজার মণ পাথর ভেঙে মাঝখানের কুঠুরিতে ঢুকে তার ধনদৌলত লুট করার। এবং আশ্চর্য, যিনি শেষ পর্যন্ত ঢুকতে পারলেন তিনি ধন লুটের মতলবে ঢোকেননি। তিনি ঢুকেছিলেন নিছক ঐতিহাসিক জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য। ফারাওয়ের রাজমিস্ত্রিরা কুঠুরি বানানো শেষ করার পরে বেরোবার সময় এমনই মন্ত পাথর দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বাইরের দেয়ালে পালিশ পলস্তরা লাগিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর মানুষের সাড়ে ছহাজার বছর লাগল ভিতরে যাবার রাস্তা বের করতে!