.
কাইরোতে বৃষ্টি হয় অতি দৈবাৎ। তা-ও দু এক ইঞ্চির বেশি নয়। তাই লোকজন সব বসেছে হোটেল-কাফের বারান্দায় কিংবা চাতালে। শুনলাম, এখানকার বায়স্কোপও বেশিরভাগ হয় খোলামেলাতে।
বাঙলা দেশে আমরাও চায়ের দোকানে বসে গালগল্প করে সময় কাটাই। কেউ কেউ হয়তো রোজ একই দোকানে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাটায়, কিন্তু কাফেতে বসে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটানোর রেওয়াজ আরম্ভ হয় ফ্রন্টিয়ার থেকে। কাবুলে দেখবে, চার বন্ধু চলেছেন বরফ ভেঙে চা-খানায় গিয়ে গল্পগুজব করবেন বলে যেমন বাড়িতে বসে ও-কর্মটি করা যায় না। ওদের জিগ্যেস করলে তারা বলে বাড়িতে মুরুব্বিরা রয়েছেন, কখন এসে কাকে ধমক লাগান তার ঠিক নেই। কিংবা হয়তো বলবেন, দেখ বাছা, ফিরোজ বস্তৃত যাও দিকিনি মামার বাড়িতে (আড়াই মাইলের ধাক্কা) সেখানে গিয়ে মামাকে বলো, আমার নাকের ফুস্কুড়িটা একটু সেরেছে, তিনি যেন চিন্তা না করেন। আর দেখো, আসবার সময় ধোপানিকে একটু শুধিয়ে এস (সে আরও দেড়-মাইলের চক্কর)– আমার নীল জোব্বাটা, ইত্যাদি।
এবং সবচেয়ে বড় কারণ, বাড়িতে মা-জ্যাঠাইমা ওরকম জালা জালা চা দিতে রাজি হন না। ওনারা যে কঞ্জুস তা নয়। আমি যদি এখুনি বলি, জ্যাঠাইমা, আমার বন্ধুরা এসেছে, ওরা বলেছে, পিসিমার বিয়ের দিনে আপনি যে দু-মুসল্লম করেছিলেন তারা সেইটে খাবে। কিন্তু ওদের বায়নাক্কা, দুম্বার ভিতর যেন কোফতা পোলাও আর মুরগি থাকে, মুরগির ভিতর যেন পোলাও আর আণ্ডা থাকে এবং আণ্ডার ভিতর যেন পোনা মাছের পূর থাকে–জ্যাঠাইমা তদ্দণ্ডেই লেগে যাবেন ওই বিরাট রান্না করতে। তাতে দশ-বিশ টাকা যা লাগে লাগুক।
অথচ আমাদের চায়ের খরচা এক সন্ধ্যায় কতটুকুন? দু আনা চার আনা, মেরে কেটে আট আনা। উঁহু, সেটি হচ্ছে না। ঘন ঘন চা খেলে নাকি ক্ষিদে মরে যায়, আহারের রুচি একদম লোপ পেয়ে যায়।
তাই, ভাই চায়ের দোকানই প্রশস্ততর। সেখানে একবার ঢুকতে পারলে বাবা-চাচার তম্বিতম্বার ভয় নেই, মামা-বাড়িতে গিয়ে বাবার নাকের ফুসকুড়িটার লেটেস্ট বুলেটিন ঝাড়তে হয় না, জালা জালা চা পাওয়া যায়, অন্য দু-চারজন ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে মোলাকাতও হয়, তাস-দাবা যা খুশি খেলাও যায় সেখানে যাব না তো, যাব কোথায়?
প্রথমবারেই প্রথম কাবুলি ভদ্রসন্তান যে আমাকে এইসব কারণ এক নিশ্বাসে বুঝিয়ে বলেছিল তা নয়, একাধিক লোককে জিগ্যেস করে ক্রমে ক্রমে চায়ের দোকানে যাবার যাবতীয় কারণ আমি জানতে পেরেছিলুম।
আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, এঁরা সত্য কথাই বলেছিলেন, এবং এঁরা যে ঘর ছেড়ে চায়ের দোকানে যান তাতে আপত্তি করবার কিছুই নেই।
কিন্তু প্রশ্ন, বাঙালিদের বেলাও তো এইসব আপত্তি-ওজুহাত টেকে? আমাদের মা-পিসিরাও চান না আমরা যেন বড় বেশি চা গিলি, বাবা-কাকাও ফাই-ফরমায়েস দেওয়াতে অতিশয় তৎপর; তবে আমরা চায়ের দোকানকে বাড়ির ড্রয়িংরুম করে তুলিনে কেন?
এর সদুত্তর আমি এ যাবৎ পাইনি। তা সে যাই হোক, এটা বেশ লক্ষ করলুম, রাত বারোটা-একটা অবধি কাফেতে বসে সময় কাটানোতে কাইরোবাসী সবচেয়ে বড় ওস্তাদ; বন্ধুর বাড়িতে জমানো আচ্ছা দশটা-এগারটার ভিতর ভেঙে যায়, কারণ বাড়িসুদ্ধ লোক তাড়া লাগায় খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ার জন্য। এখানে সে ভয় নেই। উঠি-উঠি করে কেউই ওঠে না। বাড়ির লোকেরও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তারা আর একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। শুনছি, এখানকার কোনও কোনও কাফে খোলে রাত বারোটায়!
মোটরগাড়ি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে বলে ভালো করে সবকিছু দেখতে পেলুম না। কিন্তু এইবারে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতি রমণীয় এক দৃশ্য! নাইল, নীল নদ।
আমি পুব বাঙলার ছেলে। যা তা নদী আমাকে বোকা বানাতে পারে না। আমি যে গাঙে সাঁতার কাটতে শিখেছি সেই ছোট্ট মনু নদ থেকে আরম্ভ করে আমি বিস্তর মেঘনা- পদ্মা, গঙ্গা-যমুনা এবং পরবর্তী যুগে গোদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী তাপ্তী-নর্মদা-সিন্ধু, ইয়োরোপে রাইন-ডানয়ব-মোজেল-রোন দেখেছি। নদী দেখলে আর পাঁচ জন বাঙালের মতো আমিও গামছা খুঁজতে আরম্ভ করি– ওই নদীতে কটা লোক গত সাতশো বছরে ডুবে মরেছিল তার স্ট্যাটিসৃটিকসের সন্ধান না নিয়ে একটা ডিঙি কী কৌশলে চুরি করা যায় তার সন্ধানে মাথায় গামছা বেঁধে নিই, পাটনিকে কী প্রকারে ফাঁকি দিয়ে খেয়ানৌকো থেকে নামাতে হয় সেটা এক মুহূর্তেই আবিষ্কার করে ফেলি।
এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাটিয়ালি গীত! সৃষ্টিকর্তা যদি তাঁর পুব-বাংলার লীলাঙ্গনে শত শত নদীর আলপনা না আঁকতেন তবে কি কখনও ভাটিয়ালি গানের সৃষ্টি হত? আর একথাও ভাবি, তিনি রয়েছেন মোহনিয়া প্রবাহিনী আর আমরা তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রচেছি ভাটিয়ালি। অবশ্য তারই কাছ থেকে ধার করে। আমরা যখন ও-ও-ও বলে ভাটিয়ালির লম্বা সুর ধরি, মাঝে মাঝে কাঁপন জাগাই তখন কি স্পষ্ট শুনতে পাও না, দেখতে পাও না ও-র লম্বা টানে যেন নদী শান্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে, যখন কাঁপন লাগাই তখন মনে হয় না, নদী যেন হঠাৎ থমকে গিয়ে দ-এর সৃষ্টি করেছে?
প্যারিস-ভিয়েনার রসিকজনের সম্মুখে আমি আমার হাজারোটা নদী কাঁধে বয়ে নিয়ে হাজির করতে পারব না, কিন্তু ভাটিয়ালির একখানা উত্তম রেকর্ড শুনিয়ে দিতে পারি।