তার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তবে, ভাইরা, আমরা তা হলে অন্য ট্যাক্সি নিই। তোমরা সুয়েজ ফিরে যাও। আল্লা তোমাদের সঙ্গে থাকুন। রসুল তোমাদের আশীর্বাদ করুন। কিন্তু ভাই, এ ক-ঘণ্টা তোমাদের সঙ্গে কেটেছিল বড় আনন্দে।
কেটেছিল আনন্দে না কচু! পারলে আবুল আসফিয়া ওদের গলা কাটতেন।
কিন্তু আশ্চর্য হলুম লোকটার ভণ্ডামি দেখে। গুটিকয়েক টাকা বাঁচাবার জন্য কী অভিনয়ই না লোকটা করল!
আর পায়রার মতো বকবকানি! এবং এ সেই লোক যে জাহাজে যেভাবে মুখ বন্ধ করে থাকত তাতে মনে হত কথা বলা রেশন্ড হয়ে গিয়েছে।
ঠিক আবুল আসফিয়ার দরে নয়, তার চেয়ে সামান্য একটু বেশি রেটে তারা শেষটায় রাজি হল।
আবুল আসফিয়া মোগলাই কণ্ঠে বললেন, পিরামিড। ততক্ষণে আমরা কাইরো শহরের ঠিক মাঝখানে ঢুকে গিয়েছি।
কোথায় লাগে কলকাতা রাত বারোটার সময় কাইরোর কাছে। গণ্ডায় গণ্ডায় রেস্তোরাঁ, হোটেল, সিনেমা, ডান্স-হল, ক্যাবারে। খদ্দেরে খদ্দেরে তামাম শহরটা আবৃজা করছে।
আর কত জাত-বেজাতের লোক।
ওই দেখ, অতি খানদানি নিগ্রো। ভেড়ার লোমের মতো কোঁকড়া কালো চুল, লাল লাল পুরু দুখানা ঠোঁট, বোঁচা নাক, ঝিনুকের মতো দাঁত আর কালো চামড়ার কী অসীম সৌন্দর্য! আমি জানি এরা তেল মাখে না কিন্তু আহা! ওদের সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন তেল ঝরছে। এদের চামড়া এতই সুচিকূণ সুমসৃণ যে আমার মনে হয়, এদের শরীরে মশা-মাছি বসতে পারে না পিছলে পড়ে মশার পা ছ-খানা কম্পাউন্ড ফ্রেকচর হয়ে যায়, ছ মাস পট্টি বেঁধে হাসপাতালে থাকতে হয়।
ওই দেখো সুদানবাসী। সবাই প্রায়ই ছ ফুট লম্বা। আর লম্বা আলখাল্লা পরেছে বলে মনে হয় দৈর্ঘ্য ছ ফুটের চেয়েও বেশি। এদের রঙ ব্রোঞ্জের মতো। এদের ঠোঁট নিগ্রোদের মতো পুরু নয়, টকে লালও নয়। কিন্তু সবচেয়ে দেখবার জিনিস ওদের দুখানি বাহু। এক্কেবারে শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে আজানুলম্বিত– অর্থাৎ জানুর শেষ পর্যন্ত যেখানে হাঁটুর হাড্ডি অর্থাৎ নি-ক্যাপ সেই অবধি।
শ্রীরামচন্দ্রের বাহু ছিল আজানুলম্বিত এবং তার রঙ ছিল নবজলধরশ্যাম, কিংবা নবদূর্বাদলশ্যাম। তবে কি শ্যামবর্ণ কিংবা ব্রোঞ্জবর্ণ না হলে বাহু এতখানি লম্বা হয় না। তবে কি ফর্সাদের হাত বেঁটে, শ্যামলিয়াদের হাত লম্বা? কে জানে! সুযোগ পেলে কোনও এক নৃতাত্ত্বিককে জিগ্যেস করতে হবে।
হঠাৎ দেখি, সম্মুখে হৈ-হৈ-রৈরৈ-কাণ্ড! লোকে লোকারণ্য!
সমস্ত রাস্তা জুড়ে এত ভিড় যে দুখানা গাড়িকেই বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হল। আমি বারণ করার পূর্বেই পল-পার্সি দু জনই লাফ দিয়ে উঠে গেল হুডের উপর। ওরা দেখতে চায় ভিড়ের মাঝখানে ব্যাপারটা কী। আমার ওসব জিনিস দেখবার বয়স গেছে। মাদমোয়াজেল ক্লদে শেনিয়ে পর্যন্ত উঠি উঠি করছিলেন; আমি তাকে বাইরে যেতে বারণ করলুম।
ইতোমধ্যে ঘোড়সওয়ার পুলিশ এসে রাস্তা খানিকটে সাফ করে দেওয়াতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। পুল-পার্সি হুড থেকে নেমে এসে আমার দু পাশে বসেছে।
আমাকে কিচ্ছুটি জিগ্যেস করতে হল না ব্যাপার কী। ওরা উত্তেজনায় তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে। একসঙ্গে কথা বলছে। শেষটায় পলকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, পার্সি তুমিই বল কী হয়েছিল?
ওই যে আপনি দেখালেন সুদানবাসীদের তাদেরই একজন একটা ইংরেজ সেপাইয়ের গলা ধরেছে বাঁ হাত দিয়ে আর ঠাস ঠাস করে চড় মারছে ডান হাত দিয়ে। গোরা কিছুই করতে পারছে না, কারণ সুদানির হাত লম্বা বলে গোরাকে এমনই দূরে রেখেছে যে, গোরা তার গাল নাগাল পাচ্ছে না। এরকম তো চলল মিনিট দু-তিন। তার পর পুলিশ এসে গোরাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।
আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালম, সুদানিই তো ঠ্যাঙাচ্ছিল, তাকে ধরে নিয়ে গেল না? যে মার খেল তাকে ধরে নিয়ে গেল, যে মার দিল তাকে ধরে নিয়ে গেল না, এটা কী করে হয়?
পল-পার্সি সমস্বরে বললে, সেই তো মজার কথা, স্যর। সাংহাই-টাংহাই কোনও জায়গাতে কেউ যদি গোরাকে ঠ্যাঙায়, তবে তাকেই ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। কেউ একবারের তরেও প্রশ্ন করে না দোষটা কার?
আমি তখন ড্রাইভারকে রহস্য সমাধান করার জন্য অনুরোধ জানালুম।
ড্রাইভার বললে, দারোয়ানির কাজ এ দেশে করে সুদানিরা। তাদের ওপর কাইরোবাসীদের অসীম বিশ্বাস। কোনও সুদানি কখনও কোনও বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, একথা আমি বলতে পারব না, কিন্তু আমার কানে কখনও পৌঁছায়নি। এরা বড়ই ধর্মপ্রাণ। পাঁচওত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ যায়, তসবি জপে। আর বসে বসে বাড়ি আগলায়। এই যে সুদানি গোরাকে মার দিচ্ছিল, সে এক রেস্তোরাঁর দারোয়ান। গোরা রেস্তোরাঁয় খেয়ে-দেয়ে পয়সা না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল বলে হোটেলওলা তাকে চ্যালেঞ্জ করে খেল ঘুষি। তখন সুদানি দারওয়ান তার যা কর্তব্য তাই করেছে। পুলিশ একবার জিগ্যেস করেই বিশ্বাস করেছে সুদানিকে, আর ধরে নিয়ে গিয়েছে গোরাকে। সবাই জানে, সুদানিরা বড় শান্ত স্বভাব, তারা মারপিটের ধার ধারে না।
যাক, সব বোঝা গেল। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করব; একা একা কারও সাহায্য না নিয়ে পল্টনের গোরাকে ঠ্যাঙাতে পারে সুদানিই। পাঠান পারে কি না জানিনে, পারলে পারতেও পারে, কিন্তু তার বাহু আজানুলম্বিত নয় বলে সে-ও নিশ্চয় দু চার ঘা খাবে।