কেউ যদি পা পিছলে পড়ে,
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,
কাজীর কাছে হয় বিচার
একুশ টাকা দণ্ড তার।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে,
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে;
হাঁচলে পরে বিনা টিকিতে
দমদমাদম্ লাগায় পিঠে
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।*
কী জানি কী ব্যাপার!
[* সুকুমার রায়, আবোল-তাবোল, পৃ. ৩২, তৃতীয় সিগনেট সংস্করণ।]
এমন সময় দেখি, সেই লোকটা শসা চিবুতে আরম্ভ না করে তার মাঝখানে দিল দুহাতে চাপ। অমনি হড়হড় করে বেরিয়ে এল পোলাও জাতীয় কী যেন বস্তু, এবং তাতেও আবার কী যেন মেশানো। আমি অবাক! হোটেলওলাকে গিয়ে বললুম, যা আছে কুলকপালে, আমি ওই শসাই খাব।
এল দু খানা শসা।*[* আসলে শসা নয়, একরকমের ছোট লাউ।] কাঁটা দিয়ে একটুখানি চাপ দিতেই বেরিয়ে এল পোলাও। সে পোলাওয়ের ভিতর আবার অতি ছোট ছোট মাংসের টুকরো (এদেশে যাকে বলা হয় কিমা) টমাটোর কুচি এবং গুঁড়নো পনির। বুঝলুম এসব জিনিস পুরেছে সেদ্ধ শসার ভিতর এবং সেই শসাটা সর্বশেষে ঘিয়ে ভেজে নিয়েছে। যেন মাছ-পটলের দোলমা শুধু মাছের বদলে এখানকার শসায় পোলাও, মাংস, টমাটো এবং চিজ! তার-ই ফলে অপূর্ব এই চিজ।
শসাকে চাক্তি করে পোলাওয়ের সঙ্গে মুখে দিয়ে বুঝলুম, একই সঙ্গে ভাত, মাংস, শবজি, ফল এবং সেভরি খাওয়া হয়ে গেল।
আর সে কী সোয়াদ! মুখে দেওয়ামাত্র মাখনের মতো গলে যায়।
এরকম পাঁচেক্কে পাঁচ পদ আমি পৃথিবীতে আর কোথাও খাইনি।
আরেকটা জিনিস খেলুম সে-ও অতুলনীয়। মিশরি শিম-বিচি। আলীবাবা বায়স্কোপে যে সব বিরাট বিরাট উঁচু তেলের জালা দেখছ তারই গোটা দু তিন সিমেতে ভর্তি করে সমস্ত রাত ধরে চালায় সিদ্ধক। সেই সিমে অলিভঅয়েল আর একরকমের মসলা মিশিয়ে খেতে দেয় সকালবেলা থেকে। আমরা খেলুম রাত্তিরে। তার যা সোয়াদ! এখনও জিভে লেগে আছে। আমাদের শিম-বিচি তার কাছে কিছুই না। পল-পার্সিও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করল চীন দেশের সোয়াবিনও এর সামনে কেন, পিছনেও দাঁড়াতে পারে না।
শুনলুম এই শিম-বিচি গরিব থেকে আরম্ভ করে মিশরের রাজা দু-সন্ধ্যা খেয়ে থাকেন। হোটেলওলা বললে, পিরামিড নির্মাতা এক ফারাও মহারাজ নাকি এই বিন খেতে এত ভালোবাসতেন যে, প্রজাদের বারণ করে দিয়েছিলেন তারা কেউ যেন বিন না খায়! সাধে কি আর লোকে ফারাওদের খামখেয়ালি বলত?
শুনলুম এই বিনের আরবি শব্দ ফুল।
পরের দিন সকাল বেলাকার ঘটনা। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ আছে বলে এই সুবাদেই বলে নিই।
কাইরোতে ফরাসি, গ্রিক, ইতালি, ইংরেজ বসবাস করে বলে এবং জাত-বেজাতের বিস্তর টুরিস্ট আসে বলে কাইরোর বহু দোকানি তরো-বেতনরা ভাষায় সাইনবোর্ড সাজায়। পরদিন সকালবেলা আমরা যখন শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরছি তখন দেখি, এক সাইনবোর্ডে লেখা–
FOOLS RESTAURANT
পল, পার্সি, আমি একসঙ্গেই বোর্ডটা দেখেছিলুম। একসঙ্গেই থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলুম। একসঙ্গেই অট্টহাস্য করে উঠলুম।
আহাম্মুকদের রেস্তোরাঁ।
বলে কী?
তখন হঠাৎ ঝাঁ করে আমার মনে পড়ল Fool শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে ফুল অর্থাৎ বিন অর্থাৎ সিমের-বিচি অর্থে। আহাম্মুক অর্থে নয়। অর্থাৎ এ দোকানি উত্তম শিম-বিচি বেচে। তার পর দোকানের সামনে আমরা ত্রিমূর্তি উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখি, যে কটি খদ্দের সেখানে বসে আছে তাদের সক্কলেরই সামনে শুধু শিম-বিচি ফুল–Fool।
***
হাসলে তো?
আমিও হেসেছিলুম।
কিন্তু তার পর কলকাতা ফিরে– বহু বৎসর পরে দেখি, এক দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা–
কপির শিঙাড়া
অর্থাৎ ফুলকপির-পুর-দেওয়া শিঙাড়া। এই তো?
আমি কিন্তু কপি শব্দের অর্থ নিলুম বাদর। অর্থাৎ বাঁদরদের শিঙারা। তা হলে অর্থ দাঁড়াল, ও দোকানে যারা শিঙাড়া খেতে যায় তারা বাদর। অর্থাৎ Fools Restaurant-তে যেরকম আহাম্মুকরা যায়!
যেমন মনে কর, যখন সাইনবোর্ডে লেখা থাকে—
টাকের ঔষধ
তখন কী তার অর্থ, টাকা দিয়ে এ ঔষধ তৈরি করা হয়েছে। তার অর্থ এ ঔষধ টেকোদের জন্য। অতএব কপির শিঙাড়ার অর্থ ফুলকপি দিয়ে বানানো শিঙাড়া নয়, কপি–বাঁদরদের জন্য এ শিঙাড়া!
বিজ্ঞাপনে মানুষ জানা-অজানাতে– অজানাতেই বেশি– কত যে রসিকতার সৃষ্টি করে তার একটি সচিত্র কলেকশন করেছিল আমার এক ভাইপো। হবিটা মন্দ নয়। তার মধ্যে একটা ছিল;–
বিশুদ্ধ ব্রাম্ভনের হাটিয়াল।
মচ্ছ– (চার আনা)
মাঙ্গশ– (আট আনা)
নিড়ামিস- (ছয় আনা)
যাক গে এসব কথা। আবার কাইরো ফিরে যাই। আহারাদি সমাপ্ত করে আমরা ফের গাড়িতে উঠলুম। আবুল আসফিয়া দেখলুম ড্রাইভারদের নিজের পয়সায় খাওয়ালেন। তার পর গাড়িতে উঠে বললেন, কাইরোতে ট্যাক্সি চালাবার অনুমতি তোমাদের নেই। অথচ আমরা তোমাদের বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি। আমাদের যেখানে খুশি নিয়ে গিয়ে দু পয়সা কামাতে পার।
তারা তো প্রাঞ্জল প্রস্তাবখানা শুনে আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু আবুল আসফিয়া যে দর হাঁকলেন তা শুনে তাদের পেটের ফুল পর্যন্ত আচমকা লাফ মেরে গলা পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
ব্যাপারটা হয়েছে কী, আবুল আসফিয়া ইতোমধ্যে কাইরোতে ট্যাক্সি ফি মাইলে কত নেয় খবরটা জেনে নিয়েছেন এবং হাঁকছেন তার চেয়ে অনেক কম। এবার তিনি ওদের বাগে পেয়েছেন। ওরা বেশি কিছু আপত্তি জানালেই তিনি অভিমানভরা কণ্ঠে বলেন, তা ভাই, তোমরা যদি না যেতে চাও তবে যাবে না। আমি আর তোমাদের বাধ্য করতে পারিনে। তোমাদের যদি, ভাই, বড্ড বেশি পয়সা হয়ে যাওয়ায় আর কামাতে না চাও, তা হলে আমি আর কী করতে পারি বল। আল্লাতালাও তো কুরআন শরিফে বলেছেন, সন্তুষ্টি সদ্গুণ।