বাঙালি তেড়ি কাটতে ব্যস্ত, ইংরেজ সমস্তক্ষণ টাইটা ঠিক গলার মাঝখানে আছে কি না তার তদারকিতে ব্যস্ত, শিখেরা পাগড়ি বাঁধতে ঘণ্টাখানেক সময় নেয়, কাবুলিরা হামেহাল জুতোতে পেরেক ঠোকাতে ব্যতিব্যস্ত, আর কাইরোবাসীরা দেখলুম বুৎ বালিশের নেশাতে মশগুল। তা না হলে রাতদুপুরে গণ্ডায় গণ্ডায় বুৎ বালিশওয়ালারা কাফে-রেস্তোরাঁয় ধন্না দিতে যাবে কেন?
তবে হ্যাঁ, পালিশ করতে জানে বটে। স্পিরিট দিয়ে পুরনো রঙ ছাড়াল, সাবানজল দিয়ে অন্য সব ময়লা সাফ করল, ক্রিম লাগাল, পালিশ ছোঁয়াল, প্রথম হাল্কা ক্যাম্বিস পরে মোলায়েম সিঙ্ক দিয়ে জুতোর জৌলুস বাড়াল। তখন জুতোর যা অবস্থা! তাতে তখন আয়নার মতো মুখ দেখা যায়। বুরুশের ব্যবহার তো প্রায় করলই না– চামড়া নাকি তাতে জখম হয়ে যায়।
কিন্তু আশ্চর্য বোধ হল, সেই ঝাঁ চকচকে জুতোজোড়াকে সর্বশেষে কাপড় দিয়ে ঘষে অল্প– অতি অল্প– ম্যাটমেটে করে দিল কেন? এতখানি মেহনত করে চাকচিক্য জাগানোর পর সেটাকে ম্যাটমেটে করে দেবার কী অর্থ?
একটা গল্প মনে পড়ল :
এক সাহেব পেসট্রিওয়ালাকে অর্ডার দিলেন একটা জন্মদিনের কেক বানাবার জন্যে। কেকের উপর যেন সোনালি-নীলে তার নামের আদ্য অক্ষর পি. বি. ডাবলইউ লেখা থাকে। ডেলিভারি নেবার সময় দোকানদারকে বললেন, হু, কেকটি দেখাচ্ছে উত্তম, কিন্তু হরফগুলো বানানো হয়েছে সোজা অক্ষরে। আমি চাই ট্যারচা ধরনে, ফ্লুরাল ডিজাইনে।
দোকানি খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করতে চায়। বললে এক্ষুণি করে দিচ্ছি। জন্মদিনের ব্যাপার চাট্টিখানি কথা নয়।
প্রচুর পরিশ্রম করে সে কেকের উপরটা চেঁচে নিল। তার পর প্রচুরতম গলদৃঘর্ম হয়ে তার উপর হরফগুলো বাঁকা ধরনের আঁকল, আরও মেলা ফুল ঝালর চতুর্দিকে সাজাল।
সায়েব বললেন, শাবাস, উত্তম হয়েছে।
দোকানি খুশি হয়ে শুধাল, প্যাক করে আপনাকে দেব, না কোনও বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে?
সাহেব হেসে বললেন, কোনওটাই না। আমি ওটা নিজেই খাব।
বলেই ছুরি দিয়ে চালা চা করে গব-গব করে আস্ত কেকটা গিললেন। দোকানি তো থ। তা হলে অত-শত করার কী ছিল প্রয়োজন?
বুৎ বালিশের বেলাও তাই।
বুৎ বালিশওলাকে শুধালুম, পালিশ কমিয়ে দেওয়ার কারণটা কী?
একটুখানি হকচকিয়ে সামলে নিয়ে বললে, গাইয়ারাই শুধু অত্যধিক চাকচিক্য পছন্দ করে। শহরের ভদ্রলোক সব জিনিসেরই মেকদার মেনে চলেন।
অ-অ-অ-!
তখন মনে পড়ল, অবন ঠাকুরও বলেছেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা আগের দিনে সোনার গয়না পরে পাল্কিতে বেরুবার সময় তার উপর মলমলের পট্টি বেঁধে দিতেন। বড় বেশি চাকচিক্য নাকি গ্রাম্যজনসুলভ বর্বরতা!
.
১৭.
আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনা; ঝাল অতি সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরিজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা এবং বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভালো কেক-পেট্রি-পুডিং বানাতে জানে– তাও সে শিখেছে ইতালিয়ানদের কাছ থেকে এবং একথাও বলব আমাদের সন্দেশ রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমনকি, যে নাম শুনে মূর্ছা যাব?
মিশরীয় রান্না ভারতীয় রান্নার মামাত বোন অবশ্য ভারতীয় মোগলাই রান্নার। আমি প্রমাণ করতে পারব না, কিন্তু বহু দেশে বহু রান্না খেয়ে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, মোগলরা এ দেশে যে মোগলাই রান্নার তাজমহল বানালেন (এবং ভুললে চলবে না সে রান্না তাঁর আপন দেশে নির্মাণ করতে পারেননি, কারণ ওঁদের মাতৃভূমি তুর্কিস্থানে গরম মসলা গজায় না) তারই অনুকরণে আফগানিস্থান, ইরান আরবিস্থান, মিশর-ইস্তেক স্পেন অবধি আপন আপন ক্ষুদে ক্ষুদে রান্নার তাজমহল বানাতে চেষ্টা করেছে। এ রান্নার প্রভাব পূর্ব-ইয়োরোপের গ্রিস, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, ইতালি পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এসব তত্ত্ব আমার বহুদিনকার পরের আবিষ্কার। উপস্থিত আবুল আসফিয়া আর ক্লোদেৎ নিয়ে এলেন বারকোশে হরেকরকম খাবারের নমুনা। তাতে দেখলুম, রয়েছে মুরগি মুসল্লম, শিককাবাব, শামিকাবাব আর গোটা পাঁচ-ছয় অজানা জিনিস। জানা জিনিসগুলো যে ঠিক ঠিক কলকাত্তাই খুশবাই নিয়ে এল তা নয়, কিন্তু তাতেই-বা কী? জাহাজের আইরিশ স্টু আর ইটালিয়ান মাক্কারনি খেয়ে খেয়ে পেটে তো চর পড়ে গিয়েছে; এখন এসব জিনিসই অমৃত। আমার প্রাণ অবশ্য তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য অত-শত বলি কেন, শুধু ঝোলভাতের জন্য, কিন্তু এসব জিনিস তো আর বাঙলা দেশের বাইরে পাওয়া যায় না, কাজেই শোক করে কী লাভ?
তাই দেখিয়ে দিলুম, আমার কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন সেই বারকোশ থেকেই।
পাশের টেবিলে দেখি, একটা লোক তার প্লেটে দুটি শসা নিয়ে খেতে বসেছে। দুটি শসা– তা সে যত তিন ডবল সাইজই হোক না– কী করে মানুষের সম্পূর্ণ ডিনার হতে পারে বহু চিন্তা করেও তার সমাধান করতে পারলুম না। তা-ও আবার দোকানে ঢুকে, টেবিল-চেয়ার নিয়ে সস্-চাটনি সাজিয়ে। আর ইংলন্ডের মতো খানদানি দেশেও তো মানুষ রাস্তায় দুটো আপেল কিনে চিবোয় রেস্তোরাঁয় ঢুকে সস্-চাটনি নিয়ে সেগুলো খেতে বসে না। তবে কি এদেশ ইংল্যান্ডের চেয়েও খানদানিতর? এদেশে কি এমন সব সর্বনেশে আইন-কানুন আছে যে রাস্তায় শসা বিক্রি বারণ, যে রকম শিব ঠাকুরের আপন দেশে,