আমার খেতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ওইসব সায়েব-মেমরা যখন রয়েছেন তাঁরা ‘মঁ দিয়ো’, ‘হ্যার গট’ কী যে বললেন তার তো ঠিকঠিকানা নেই।
আচম্বিতে দুখানা গাড়িই দাঁড়াল। বসে বসে সবাই অসাড় হয়ে গিয়েছি। সব্বাই নেমে পড়লুম। সক্কলেরই মনে এক কামনা। আড়ামোড়া দিয়ে নিই, পা দুটো চালিয়ে নিই, হাত দু খানা ঘুরিয়ে নিই।
এমন সময় আবুল আসফিয়া আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, মাথা পিছনের দিকে ঈষৎ ঠেলে দিয়ে, হাত দুখানা সামনের দিকে সম্প্রসারিত করে, পোলিটিশিয়নদের কায়দায় শ্ৰদ্ধানন্দ-পার্কি লোর ঝাড়তে আরম্ভ করলেন, কিন্তু ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে
মেদাম, মেমোয়াজেল এ মেসিয়ো–
(ভদ্রমহিলাগণ, ভদ্রকুমারীগণ এবং ভদ্রমহোদয়গণ)
আমরা সকলেই এক্ষণে তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধাতুর। নগরী প্রবেশ করত আমরা প্রথমেই উত্তম কিংবা মধ্যম শ্রেণির ভজনালয়ে আহারাদি সমাপন করব। কিন্তু প্রশ্ন, সেখানে খেতে দেবে কী? জাহাজে যা দেয় তা-ই। সেই বিস্বাদ সুপ, বিস্বাদতর স্টু, তদিতর পুডিং। অর্থাৎ সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কিংবা অ্যাংলো-ইজিপশিয়ন– যাই বলুন– রস-সহীন খানা।
পক্ষান্তরে, এই শহরতলিতে যদি আমরা কিঞ্চিৎ আদিম এবং অকৃত্রিম মিশরীয় খাদ্য, মিশরীয় পদ্ধতিতে সুপকু খাদ্য ভোজন করি তবে কি এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে না?
আমরা কিছু বলার পূর্বেই তিনি হাত দুখানা গুটিয়ে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়ের ডান দিকটা চুলকোতে চুলকোতে বললেন : অতি অবশ্য, রেস্তোরাঁগুলো নোংরা। চেয়ার-টেবিল সাফসুরো নয়, কিন্তু মেদাম, মাদমোয়াজেল, মেসিয়ে, আমরা তো আর টেবিল-চেয়ার খেতে যাচ্ছিনে। আমরা খেতে যাচ্ছি খানা। জাহাজের রান্না যখন আমাদের খুন করতে পারেনি তখন এ রান্নাই-বা করবে কী করে? আপনারাই বলুন?
কেউ কিছু বলার পূর্বেই পার্সি চেঁচিয়ে উঠল : অফুঁকোস, অকোস্ –আলবৎ, আলবৎ আমরা নিশ্চয়ই খাব। আমরা যখন মিশরীয় হাওয়াতেই খাস নিচ্ছি, মিশরীয় জলই খাব, তখন মিশরীয় খাদ্য খাব না কেন?
মাদমোয়াজেল শেনিয়ে বললেন; যারা খেতে চান না, তারা খাবেন না। আমি যাচ্ছি।
আর আমি বুঝলুম, ফরাসি দেশটা কতখানি স্বাধীনতার দেশ। স্বাধীনতা ফরাসিদের হাড়ে-হাড়ে মজ্জায়-মজ্জায়।
শেনিয়ে ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ডেলিকেট প্রাণী। জাহাজের রান্না তার পছন্দসই ছিল না বলে তিনি টোস্ট, দুধ, ডিম, মটর, কপি, আলুসেদ্ধ খেয়ে প্রাণ ধারণ করতেন। তিনি যখন রাজি তখন–?
আমার মনে হয়, আমরা যে তখন সবাই নিকটতম রেস্তোরাঁয় হুড়মুড় করে ঢুকলুম তার একমাত্র কারণ এই নয় যে, মাদমোয়াজেল ঢুকতে প্রস্তুত, আমার মনে হয় আর সবাইও তখন মিশরি খানার এক্সপেরিমেন্ট করবার জন্য তৈরি। সর্বোত্তম কারণ সবাই তখন ক্ষুধায় কাতর। কোথায় কোন খানদানি রেস্তোরাঁয় কখন পৌঁছব তার কী ঠিক-ঠিকানা? সেখানে হয়তো এতক্ষণে সব মাল কাবার। খেতে হবে মাখন-রুটি, দিতে হবে মুরগি-মটনের দর। তার চেয়ে ভর-ভর খুশবাইয়ের খাবারই প্রশস্ততর। হাতের কাছে যা পাচ্ছি, তাই ভালো, সেই নিয়ে আমি খুশি।
রবিঠাকুর বলেছেন,
কাছের সোহাগ ছাড়বে কেন
দূরের দূরাশাতে?
ইরানি কবি ওমর খৈয়ামও বলেছেন,
Oh, take the Cash, and let the Credit go,
Nor heed the rumble of distant Drum!
কান্তি ঘোষ তার বাঙলা অনুবাদ করেছেন,
নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক,
দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক!
রেস্তোরাঁগুলো ছুটে এসে আমাদের আদর-কদর করে অভ্যর্থনা (ইসতিকবাল) জানাল। তার বয়-রা বত্রিশখানা দাঁতের মুলো দেখিয়ে আকর্ণ হাসল। তড়িঘড়ি তিনখানা ছোট ছোট টেবিল একজোড়া করে, চেয়ার সাজিয়ে আমাদের বসবার ব্যবস্থা করা হল, রান্নাঘর থেকে স্বয়ং বাবুর্চি ছুটে এসে তোয়ালে কাঁধে বার বার ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাম জানাল। বসতে গিয়ে দেখি, শ্যামবাজারের সেই লোহার চেয়ার। শীত-গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই বসতে গেলে ছ্যাকা দেয়।
আমি তখন আমার অভিজ্ঞতা গিলছি। অর্থাৎ দেখছি বয়গুলোর কী সুন্দর দাঁত। এরকম দুধের মতো সুন্দর দাঁত হয় কী করে? সে দাঁতের সামনে এরকম রক্তকরবীর মতো রাঙা ঠোঁট এরা পেল কোথা থেকে? এবং ঠোঁটের সীমান্ত থেকেই সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কী অদ্ভুত এক নবীন রঙ! এ রঙ আমার দেশের শ্যামল নয়, এ যেন কী এক ব্রোঞ্জ রঙ! কী মসৃণ কী সুন্দর!
কিন্তু সর্বাধিক মনোরম বাবুর্চির ভুড়িটা। ওহ! কী বিশাল, কী বিপুল, কী জাঁদরেল!
তার থেকেই অনুমান করলুম আমরা ভালো রেস্তোরাঁতেই ঢুকেছি।
ইতোমধ্যে আবুল আসফিয়া এবং মাদমোয়াজেল শেনিয়ে বাবুর্চিকে নিয়ে খুদ রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন, আহারাদির বাছাই তদারক করতে এবং গোটাচারেক ছোকরা এসে আমাদের চতুর্দিক ঘিরে চেঁচাচ্ছে, বুৎ, বালিশ, বুৎ বালিশ!
সে আবার কী যন্ত্রণা!?!
বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না; কারণ এদের সকলের হাতে কাঠের বাক্স আর গোটা দুই করে বুরুশ। ততক্ষণে আবার মনে মনে, ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনা করে বুঝে নিয়েছি, আরবিতে ট নেই বলে বুট হয়ে গিয়েছে বুৎ এবং প নেই বলে পলিশ হয়ে গিয়েছে বালিশ–একুনে দাঁড়াল বুৎ বালিশ! তাই আরবরা পণ্ডিত জওহরলালের নাম উচ্চারণ করে বান্দিৎ জওয়াহরলাল। ভাগ্যিস আরবি ভাষায় ট নেই। থাকলে নিরীহ পণ্ডিত আরবিস্থানের ব্যান্ডিট হয়ে যেতেন! আদন অঞ্চলের আরবিতে আবার গ নেই, তাই তারা গান্ধীর নাম উচ্চারণ করে জান্দী। অবশ্য সেটা কিছু মন্দ নয়–সত্যের জন্য জান দিই বলেই তো তিনি প্রাণ দান করে দেহত্যাগ করলেন।