পল : ঠিক বলেছিস্। আর মা-বাবা কীরকম আশ্চর্য হবেন ভাব দিকিনি। কিন্তু, ভাই, ওনারা যদি তখন ধমক দেন, জাহাজ ছেড়ে তোমরা এরকম বাউণ্ডুলিপনা করতে গিয়েছিলে কেন? তখন?
পার্সি বললে : ওই তোর দোষ! সমস্তক্ষণ ভয়ে মরিস। তখন কি আর একটা সদুত্তর খুঁজে পাব না! ওই স্যর রয়েছেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা কর না। উনি কী বলেন।
আমি বললুম, দোষ দেবেন, তো তখন দেবেন। এখন সে আলোচনা করতে গিয়ে দেখবার জিনিস অবহেলা করবে নাকি? বিশেষত, যদি আমাদের অভিযান অন্যায় কর্মই হয়ে থাকে, সেটাকে যখন রদ করার শক্তি আমাদের হাতে নেই।
পার্সি বললে : আর ফিরে গিয়েই-বা কী লাভ? আমাদের জাহাজ তো অনেকক্ষণ হল ছেড়ে দিয়েছে।
চালাক ছেলে; সর্বদিকে খেয়াল রাখে।
মরুভূমিতে দিনের বেলা যেরকম প্রচণ্ড গরম, রাত্রে ঠিক তেমনি বিকট শীত। বৈজ্ঞানিকেরা তার একটা অত্যুকৃষ্ট ব্যাখ্যা দেন বটে, কিন্তু ধোপে সেটা কতখানি টেকে আমি যাচাই না করে বলতে পারব না। উপস্থিত শুধু এইটুকু বলতে পারি, জাহাজে দিনের পর দিন রাতের পর রাত দুঃসহ গরমে হাড়মাংস যেন আচার হয়ে গিয়েছিল; ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ পেয়ে সর্বাঙ্গ যেন জলে-ভেজা জুইফুলের মতো ফুলে উঠল।
এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে একাধিকবার হয়েছে। পেশাওয়ার, জালালাবাদের ১২০/১২২ ডিগ্রি সওয়ার পর আমি খা-ই-জব্বারের ৬০ ডিগ্রিতে পৌঁছতে কী আরাম অনুভব করেছিলুম সে বর্ণনা অন্যত্র করছি। কোথায়? উঁহু সেটি হচ্ছে না। বললেই বলবে, আমি সুযোগ পেয়ে আমার অন্য বইয়ের বিজ্ঞাপন এখানে নিখরচায় চালিয়ে দিচ্ছি।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম মনে নেই। যখন মোটরের হঠাৎ একটুখানি জোর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল তখন দেখি চোখের সামনে সারি সারি আলো। কাইরো পৌঁছে গিয়েছি। গাড়ির আর সবাই তখনও ঘুমোচ্ছে। আমার সন্দেহ হল ড্রাইভারও বোধ করি ঘুমোচ্ছে। গাড়ি আপন মনে বাড়ির দিকে চলেছে; সোয়ার ঘুমিয়ে পড়লেও ঘোড়া যেরকম আপন বাড়ি খুঁজে নেয়।
পার্সিকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে বললুম : তবে না, বস্ত্র, বলেছিলে, মরুভূমির সব টুকিটাকি পর্যন্ত মনের নোটবুকে টুকে নেবে? যেন আমি নিজে কতই না জেগে ছিলুম।
পার্সিও তালেবর ছেলে। তখুনি দিল পলের কানে ধরে একখানা আড়াই গজি টান। আমি পার্সিকে যা বলেছিলুম সে পলকে তাই শুনিয়ে দিল। পল বেচারী আর কী করে? সে আস্তে আস্তে মাদমোয়াজেল শেনিয়েকে জাগিয়ে দিয়ে বললে, কাইরো পৌঁছে গিয়েছি।
বাঙাল দেশে কথায় কয়– পশ্চিম বাঙলায় বলে কি না জানিনে– সায়েব বিবিকে মারলেন চড়, বিবি বাঁদিকে দিলেন ঠ্যাঙ্গা, বাঁদি বেড়ালকে মারলে লাথি, বেড়াল খামচে দিলে নুনের ছালাটাকে।
সংসারে এই রীতি!
এখানে অবশ্য প্রবাদ টায়টায় মিলল না। তাই পল অতি সবিনয়ে মেমসাহেবকে জাগিয়ে দিল।
মাদমেয়োজেল হ্যান্ডব্যাগ থেকে পাউডার বের করে নাকে ঘষতে ঘষতে ফরাসিতে শুধালেন, আমার বিশ্বাস ফরাসিনীরা ঘুমন্ত অবস্থায়ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে পারেন এবং লাগান–আমরা কোথায় পৌঁছলুম, মঁসিয়ে?
ল্য ক্যার।
পল বেশ খানিকটে ফরাসি জানত। আমাকে শুধাল : ল্য ক্যার অর্থ হল দি কাইরো। ল্যটা আবার পুংলিঙ্গ। একটা শহরের আবার পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ কী করে হয়?
আমি বললুম : অত বিদ্যে আমার নেই, বাপু! তবে এইটুকু জানি এ বাবদে ফরাসিই একমাত্র আসামি নয়। আমরা ব্ৰহ্মপুত্রকে বলি নদ, অর্থাৎ পুংলিঙ্গ এবং গঙ্গাকে বলি নদী অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গ। কেন বলি জানিনে।
পার্সি বললে : আমরা ইংরেজরাই-বা জাহাজকে শি অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গ দিয়েছি কেন?
আমি বললুম : উপস্থিত এ আলোচনা অক্সফোর্ডের জন্য মুলতুবি রেখে দাও– সেখানেই তো পড়তে যাচ্ছ– এবং নিশির কাইরোর সৌন্দর্যটি উপভোগ করে নাও।
সত্যি, এরকম সৌন্দর্য সচরাচর চোখে পড়ে না। আমরা যখন চন্দননগর থেকে কলকাতা পৌঁছই তখন মাঝখানে ঘনবসতি আর বিস্তর জোরালো বাতি থাকে বলে কলকাতার রোশনাই ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনে। এখানে মরুভূমি পেরিয়ে হঠাৎ শহর বলে একসঙ্গে সব-কটা আলো চোখে পড়ে এক অদ্ভুত মরীচিৎকার সৃষ্টি করে।
ছ-তলা বাড়ির উপরে অবশ্য বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না– দেখি, লাল আলোতে জ্বালানো সেলাইয়ের কলের উঁচ ঘন ঘন উঠছে-নামছে, আর সবুজ আলোর চাকা ঘুরেই যাচ্ছে ঘুরেই যাচ্ছে। নিচে এক বিলিতি কোম্পানির নাম। আমার মনে হল, হায়! কলটার নাম যদি উষা হত। সেদিন আসবে যেদিন ভারতীয়– যাগে।
আরও কতরকমের প্রজ্বলিত বিজ্ঞাপন। এ বিষয়ে কলকাতা কাইরোর পিছনে।
করে করে শহরতলিতে ঢুকলুম। কলকাতার শহরতলি রাত এগারোটায় অঘোরে ঘুমোয়। কাইয়োর সব চোখ খোলা– অর্থাৎ খোলা জানালা দিয়ে সারি সারি আলো দেখা যাচ্ছে। আর রাস্তার কথা বাদ দাও। এই শহরতলিতেই কত না রেস্তোরাঁ কত না কাফে খোলা; খদ্দেরে খদ্দেরে গিসগিস করছে। (আমাদের যেরকম চায়ের দোকান, মিশরিদের তেমনি কাফে অর্থাৎ কফির দোকান! আমি প্রায়ই ভাবি কফির দোকান যদি কাফে হতে পারে তবে চায়ের দোকান চাফে হয় না কেন? চলো ভাই চাফেতে যাই বলতে কী দোষ?)।
আবার বলছি রাত তখন এগারোটা। আমি বিস্তর বড় বড় শহর দেখেছি কিন্তু কাইরোর মতো নিশাচর শহর কোথাও চোখে পড়েনি।
কাইরোর রান্নার খুশবাইয়ে রাস্তা ম-ম করছে। মাঝে মাঝে নাকে এসে এমন ধাক্কা লাগায় যে মনে হয় নেমে পড়ে এখানেই চাটি খেয়ে যাই। অবশ্য রেস্তোরাঁগুলো আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানেরই মতো নোংরা। তাতে কী যায়-আসে? কে যেন বলছে, নোংরা রেস্তোরাঁতেই রান্না হয় ভালো; কালো গাই কি সাদা দুধ দেয় না?