আশ্চর্য, এত রাত অবধি পাড় থেকে এত দূরে তারা মাছ ধরছে।
এখন যদি ঝড় ওঠে তবে তারা করবে কী? নৌকা যদি ডুবে যায় তবে তারা তো এতখানি জল পাড়ি দিয়ে ডাঙায় পৌঁছতে পারবে না। তবে তারা এরকম বিপজ্জনক পেশা নিয়ে পড়ে থাকে কেন? লাভের আশায়? নিশ্চয় নয়। সে তত্ত্ব আমি বিলক্ষণ জানি। আমি একবার কয়েক মাসের জন্য মাদ্রাজের সমুদ্রপাড়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলুম। তারই পাশে ছিল, একেবারে সমুদ্রের গা ঘেঁষে এক জেলেপাড়া। আমি পাকা ছটি মাস ওদের জীবনযাত্রা-প্রণালি দেখেছি। ওদের দৈন্য দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। আমাদের গরিব চাষিরাও এদের তুলনায় বড়লোক, এমনকি, আমাদের আদিবাসীরা, সাঁওতাল ভিলেরাও এদের চেয়ে অনেক বেশি সুখস্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করে। তোমাদের ভিতর যারা পুরির জেলেদের দেখেছ তারাই আমার কথায় সায় দেবে।
তবে কি এরা অন্য কোনও সুযোগ পায় না বলে এই বিপদসঙ্কুল, কঠিন অথচ দুঃখের জীবন নিয়ে পড়ে থাকে? আমার সেই মাদ্রাজি বন্ধু বললে, তা নয়, এরা নাকি ভোলা সমুদ্র এত ভালোবাসে যে তাকে ছেড়ে মাঠের কাজে যেতে কিছুতেই রাজি হয় না। ঝড়ের সময় মাছ ধরা প্রায় অসম্ভব বলে তখন উপোস করে দিন কাটাবে, ক্ষুধায় প্রাণ অতিষ্ঠ হলে, ভুখা কাচ্চাবাচ্চাদের কান্না সহ্য করতে না পারলে সেই ঝড়েই বেরোয় মাছ ধরতে আর ডুবে মরে সমুদ্রের অথই জলে। তবু জল ছেড়ে ডাঙার ধান্দায় যেতে রাজি হয় না।
এবং নৌকোর মাঝি-মাল্লা, জাহাজের খালাসিদের বেলাও তাই। এদের জীবন এতখানি অভিশপ্ত নয়, জানি, কিন্তু এরাও ডাঙায় ফিরে যেতে রাজি হয় না। এমনকি, যে চাষা সাতশো পুরুষ ধরে ক্ষেতের কাজ করেছে, সে-ও যদি দুর্ভিক্ষের সময় দু পয়সা কামাবার জন্য সমুদ্রে যায় তবে কিছুদিন পরই তাকে আর ডাঙার কাজে নিয়ে যাওয়া যায় না। আর পুরনো খালাসিদের তো কথাই নেই। গোপদাড়ি পেকে গিয়েছে, সমুদ্রের নোনা জল আর নোনা হাওয়ায় চামড়ার রঙটি ব্রোনজের মতো হয়ে গিয়েছে, আর কদিন বাঁচবে তার ঠিক নেই, জাহাজে কেউ চাকরি দিতে চায় না, তবু পড়ে থাকবে খিদিরপুরের এক ঘিঞ্জি আড্ডায় আর উদয়াস্ত এ-জাহাজ ও-জাহাজ করে করে বেড়াবে চাকরির সন্ধানে। ওদিকে বেশ দু পয়সা জমিয়েছে। ইচ্ছে করলেই দেশের গাঁয়ের তেঁতুলগাছতলায় নাতি-নাতনির পাখার হাওয়া খেতে খেতে গল্প-টল্প বলতে বলতে দুটি চোখ বুজতে পারে।
সমুদ্রের প্রতি এদের কেমন যেন একটা নেশা আছে, সে সম্বন্ধে তারা একটু লজ্জিত। কেন, জানিনে। তুমি যদি বল, তা, চৌধুরীর পো–চৌধুরীর পো বলে সম্বোধন করলে ওরা বড় খুশি হয়–দু পয়সা তো কামিয়েছ, আর কেন এ-জাহাজে ও-জাহাজে ঝকমারির কাজ করা। তার চেয়ে দেশে গিয়ে আল্লা-রসুলের নাম স্মরণ কর, আখেরের কথা ভাববার সময় কি এখনও আসেনি?
বড় কাচুমাচু হয়ে বুড়ো বলবে, না, ঠাকুর, তা নয়। দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলবে, আর দুটি বচ্ছর কাম করলেই সব সুরাহা হয়ে যাবে। দু পয়সা না নিয়ে নাতি-নাতনিদের ঘাড়ে চাপতে লজ্জা করে।
একদম বাজে কথা। বুড়ো জাহাজের কামে ঢোকে যখন তার বয়স আঠারো। আজ সে সত্তর। এই বাহান্ন বৎসর ধরে সে দেশে টাকা পাঠিয়েছে ভালো করে ঘর-বাড়ি বানাবার জন্য, জমি-জমা কেনার জন্য। এখন তার পরিবারের এত সচ্ছল অবস্থা যে রা জমিদারকে পর্যন্ত টাকা ধার দেয়। আর বুড়ো বলে কি না ব্যাটা-ভাইপো নাতি-নাতনি তাকে দু-মুঠো অন্ন খেতে দেবে না!
সমুদ্রের প্রতি কোনও কোনও জাহাজ-কাপ্তেনের এত মায়া যে বুড়ো বয়সে তারা বাড়ি বানায় ঠিক সমুদ্রের পাড়ে, এবং বাড়িটার ঢপও কিম্ভুতকিমাকার! দেখতে আদপেই বাড়ির মতো নয়, একদম হুবহু জাহাজের মতো অবশ্য মাটির সঙ্গে যোগ রেখে যতখানি সম্ভব। আর তারই চিলেকোঠায় সাজিয়ে রাখে, কম্পাস, দুরবিন, ম্যাপ, জাহাজের স্টিয়ারিং হুইল এবং জাহাজ চালাবার অন্যান্য যাবতীয় সরঞ্জাম। বাড়ির আর কাউকে বুড়ো সেখানে ঢুকতে দেয় না– ইউনিফর্ম পরা না থাকলে জাহাজের ও জায়গায় তো কাউকে যেতে দেওয়া হয় না– এবং সে সেখানে পাইপটা কামড়ে ধরে সমস্ত দিন বিড়বিড় করে খালাসিদের বকাঝকা করে। ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তখন সে একাই একশো। জাহাজ বাঁচাবার জন্য সে তখন ক্ষেপে গিয়ে ব্রিজময় দাবড়ে বেড়ায়, টেলিফোনে চিৎকার করে এঞ্জিন-ঘরকে হুকুম হাঁকে, আরও জলদি, পুরো স্পিডে, কখনও-বা বরষাতিটা গায়ে চাপিয়ে ব্রিজ খুলে ডেকের তদারকি করে ভিজে কাঁই হয়ে ফের ব্রিজে ঢুকবে। ঝড় না থামা পর্যন্ত তার দম ফেলার ফুরসত নেই, ঘুমুতে যাবার তো কথাই ওঠে না। ঝড় থামলে হাঁফ ছেড়ে বলবে, ওহ্, কী বাচনটাই না বেঁচে গিয়েছি। আমি না থাকলে সব ব্যাটা আজ ডুবে মরত। আজকালকার ছোঁড়ারা জাহাজ চালাবার কিস্-সু-টি জানে না। তার পর টেবিলে বসে আঁকাবাঁকা অক্ষরে জাহাজের ক্রুদের ধন্যবাদ জানাবে, তারা যে তার হুকুম তামিল করে জাহাজ বাঁচাতে পেরেছে তার জন্য। তার পর ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ যে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার বেয়ারিঙ নেবে বিস্তর ল্যাটিটুড-লঙিটুড কষে এবং শেষটায় হাঁটু গেড়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরম পরিতৃপ্তি সহকারে হাই তুলতে তুলতে আপন কেবিনে শুতে যাবে।