আমরা হুড়মুড় করে দু খানা ট্যাকসিতে কাঁঠালবোঝাই হয়ে গেলুম।
আমি অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে ওঠার সময় বললুম, আপনি আমাদের জন্য এতখানি করলেন। সত্যই আপনার দয়ার শরীর।
তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যা বললেন তা শুনে আমি অবাক। তার অর্থ তার শরীর আদপেই দয়ার শরীর নয়। তিনি কিছুমাত্র পরোপকার করেননি। আমরা একপাল ভিখিরি যদি সুয়েজ বন্দরে আটকা পড়ে যাই তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই ঘাড়ে পড়ব। আমাদের তাড়াতে পেরে তিনি বেঁচে গেছেন–ইত্যাদি।
আমি আপত্তি জানিয়ে মোটরে বসে ভদ্রলোকের কথাগুলো ভাবতে লাগলুম।
হঠাৎ বুঝতে পারলুম ব্যাপারটা কী—বহুদিন পূর্বেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে যাওয়াতে।
রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি ছিলেন তাঁর দাদার নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার এক চিত্রকর বন্ধু বিনোদবিহারী একদিন তার দুরবিনটি ধার নিল- বেচারী চোখে দেখতে পেত কম। কয়েকদিন পরে সেটা ফেরত দিতে গেলে দিনুবাবু জিগ্যেস করলেন, কী রকম দেখলে?
আজ্ঞে, চমৎকার! বিনোদ এত দূরের জিনিস এর আগে কখনও দেখতে পায়নি। তবে ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও। লোকে বড় জ্বালাতন করে। আজ ওটা এ চায়, কাল ওটা ও চায়, পরশু ওটা সে চায়। আমি পেরে উঠিনে। তোমার কাছে ওটা থাক।
বিনোদ একাধিকবার চেষ্টা করেও দুরবিন ফেরত দিতে পারেনি।
এই হল খানদানি লোকের পরোপকার পদ্ধতি। সে দেখায়, যেন সে আদপেই পরোপকার করেনি। নিতান্ত নিজের মঙ্গলের জন্য, আগাগোড়া সে স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে।
বুঝলাম এ অফিসারটিও দিনুবাবুর সগোত্র। ইচ্ছে করেই সগোত্র শব্দটি ব্যবহার করলুম; আমার বিশ্বাস ইহসংসারের যাবতীয় ভদ্রলোক একই গোত্রের– তা তারা ব্রাহ্মণ হন আর চণ্ডাল হন, হিন্দু হন আর মুসলমান হন, কাফ্রি হন আর নর্ডিক হন।
ততক্ষণে আমরা বন্দর ছেড়ে মরুভূমিতে ঢুকে গিয়েছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি, শহরের বিজলিবাতি ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে– বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো স্মৃতি যেরকম আবছায়া আবছায়া হয়ে থাকে।
.
১৬.
মরুভূমির উপর চন্দ্রালোক। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। সে দৃশ্য বাংলা দেশের সবুজ শ্যামলিমার মাঝখানে দেখা যায় না। তবে যদি কখনও পদ্মার বিরাট বালুচড়ায় পূর্ণিমা রাতে বেড়াতে যাও–রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই যেতেন এবং নিশীথে গল্প তারি পটভূমিতে লেখা– তা হলে তার খানিকটে আস্বাদ পাবে।
সমস্ত ব্যাপারটা কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হয়। চোখ চলে যাচ্ছে দূর দিগন্তে অথচ হঠাৎ যেন ঝাপসা আবছায়ার পর্দায় ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। মনে হয়, যেন দেখতে পাচ্ছি, তবু ঠিক ঠিক দেখতে পারছিনে, চিনতে পারছি তবু ঠিক ঠিক চিনতে পারছিনে। চতুর্দিকে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো যেন উপচে পড়ে মনে হয় এ আলোতে অক্লেশে খবরের কাগজ পড়া যায়, অথচ এ আলোতে লাল-কালোর তফাত যেন ঘুচতে চায় না। মেঘলা দিনে এর চেয়ে অনেক ক্ষীণালোকে রঙের পার্থক্য অনেক বেশি ধরা পড়ে।
তাই, মনে হল পাখি, মনে হল মেঘ, মনে হল কিশলয়,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়।
দুই ধারে একি প্রাসাদের সারি, অথবা তরুর মূল।
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল?
মাঝে মাঝে আবার হঠাৎ মোটরের দু মাথা উঁচুতে ফুটে ওঠে, জ্বলজ্বল দুটি ছোট সবুজ আলো; ওগুলো কী? ভূতের চোখ নাকি? শুনেছি ভূতের চোখই সবুজ রঙের হয়। নাহ! কাছে আসতে দেখি উটের ক্যারাভান এদেশের ভাষাতে যাকে বলে কাফেলা (কবি নজরুল ইসলাম এ শব্দটি বাঙলায় ব্যবহার করেছেন) উটের চোখের উপর মোটরের হেডলাইট পড়াতে চোখদুটো সবুজ হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিয়েছে। দেশে গরু-বলদের চোখে আলো পড়ে ঠিক এ রকমই হয়, কিন্তু বলদের চোখে যে লেভেলে দেখি উটের চোখে তার অনেক উপরে দেখতে পেলুম বলে এতখানি ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম।
আর কেনই পাব না বল? জনমানবহীন মরুভূমির ভিতর দিয়ে চলেছ, রাত্রিবেলা– আবার বলছি, রাত্রিবেলা। মরুভূমি সম্বন্ধে কত গল্প, কত সত্য, কত মিথ্যে পড়েছি ছেলেবেলায়। তৃষ্ণায় সেখানে বেদুইন মারা যায়, মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বেদুইন তার পুত্রের চেয়ে প্রিয়তর উটের গলা কাটে, সেখান থেকে উটের জমানো জল খেয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য, তৃষ্ণায় মতিচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে সে হঠাৎ কাপড়-চোপড় ফেলে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে সূর্যের দিকে জিভ দেখিয়ে দেখিয়ে নাচে শুষ্ককণ্ঠে বীভৎস গলায় গান জোড়ে,
তুই (অশ্লীলবাক্য)– তুই ক্যা রে?
তুই আমার কী করতে পারিস তুই ক্যা রে?
এবং তার চেয়েও বদখদ বেতালা পদ্য।
যদি মোটর ভেঙে যায়? যদি কাল সন্ধে অবধি এ রাস্তা দিয়ে আর কোনও মোটর না আসে? পষ্ট দেখতে পেলুম এ গাড়ি রওনা হওয়ার পূর্বে পাঁচশো গ্যালন জল সঙ্গে তুলে নেয়নি; তখন কী হবে উপায়?
কিন্তু করুণাময়কে অসীম ধন্যবাদ, পল-পার্সি দেখলুম অন্য ধরনের ছেলে। তারা সেই জরাজীর্ণ মোটরগাড়ির কটকটহি মরকট বিকট ভট কোটি কোটিনহ ধাবহি (তুলসীদাস তার রামায়ণে বানরদের কলরোলের বর্ণনা দিতে গিয়ে ট-এর অনুপ্রাস ব্যবহার করেছেন) শব্দ ছাপিয়ে বিকটতর কটকট করছে। তাদের কী আনন্দ!
পল : সবকিছু ভালো করে দেখে নে; মাকে যাবতীয় জিনিস যেন গুছিয়ে লিখতে পারিস।
পার্সি : তোর জীবনে এই দুই প্রথম একটা খাঁটি কথা কইলি। কোনও জিনিস যেন বাদ না পড়ে। ওহ, মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। জাহাজে চড়ার সময় কি কল্পনা করতে পেরেছিলুম। জাহাজে চড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোকটে মরুভূমির ভিতর দিয়ে চড়ে যাব?।