ঠিক সেইরকমই এক মহাপুরুষ– হিটলারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন বলে এঁর ফাঁসির হুকুম হয়– জেলে বসে কবিতা লিখেছিলেন,
ডু কান্ স উনস্ ডুর্ষ ডেস টডেস ট্যুরেন
ট্রয়েমেন্ত ফুরেন্।
উন্ট মাখস্ট উস্ আউফ আইনমাল ফ্রাই।
তুমি আমাদের মৃত্যুর দ্বার দিয়ে হাতে ধরে নিয়ে চল।
— আমরা যেন স্বপ্নে চলেছি–
হঠাৎ দেখি, আমরা স্বাধীন।
এই বই ছোটদের জন্য লেখা। তারা হয়তো শুধাবে, মৃত্যুর কথা তাদের শোনাচ্ছি কেন? আমার মনে হয়, শোনান উচিত। সাধারণত বড়রা ছোটদের যত আহাম্মুখ মনে করেন আমি বুড়ো হয়েও সেরকম ভাবিনে।
আমার বয়স যখন তেরো, তখন আমার সবচেয়ে ছোট ভাই বছর দুয়েক বয়সে মারা যায়। ভারি সুন্দর ছেলে ছিল সে। আমার কোলে বসতে বড় ভালোবাসত। ওই দু বছর বয়সে সে আমার সাইকেলের রডে বসে হ্যাঁন্ডেল আঁকড়ে ধরে থাকত আর আমি বাড়ির লনে পাক লাগাতুম। মাঝে মাঝে সে খল খল করে হেসে উঠত আর মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুশি হয়ে আমাদের দিকে তাকাতেন কিন্তু মাঝে মাঝে বলতেন, থাক হয়েছে। এখন ওকে তুই নামিয়ে দে।
একদিন সে চলে গেল।
আমি বড্ড কষ্ট পেয়েছিলুম।
তখন আমায় কেউ বুঝিয়ে বলেনি, মৃত্যু কাকে বলে? তার অর্থ যদি তখন আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলত তবে বেদনা লাঘব হত।
বড়রা ভাবেন, ছোটদের বেদনাবোধ কম। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
তোমরা যারা আমার বই পড়ছ, তোমাদের কেউ কি ভাই-বোন হারাওনি? সে বুঝবে।
কবিগুরুর ছোট ভাই-বোন ছিলেন না। তাই বিস্ময় মানি তিনি কী করে লিখলেন–
কাকা বলেন, সময় হলে
সবাই চলে
যায় কোথা সেই স্বর্গপারে।
বল তো কাকী।
সত্যি তা কি একেবারে?
তিনি বলেন, যাবার আগে
তন্দ্রা লাগে
ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি,
দ্বারের পাশে।
তখন আসে
ঘাটের মাঝি।
বাবা গেছেন এমনি করে
কখন ভোরে
তখন আমি বিছানাতে।
তেমনি মাখন
গেল কখন।
অনেক রাতে।* [* শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড ১০৮-পৃ.।]
এই কাকাটি সত্যই ছোট ছেলের বেদনা বুঝতেন।
কিন্তু মূল কথা থেকে কত দূরে এসে পড়েছি। তাই মৃত্যু সম্বন্ধে শেষ কথা বলে মূল কথায় ফিরে যাই। ভগবানে আমার অবিচল বিশ্বাস। তাই আমি জানি, আমি যখন মরণের সিংহদ্বার পার হব তখন দেখব বাবা, ঠাকুরদা, তার বাবা তার বাবা আরও কত শত ঊর্ধ্ব-পুরুষ সৌম্যবদনে এগিয়ে আসছেন আমাকে তাদের মাঝখানে বরণ করে নেবার জন্য। এবং জানি, জানি, নিশ্চয় জানি, তাঁদের সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা আমার ছোট ভাইকে হাসিমুখে কোলে নিয়ে। তার চেয়েও আশ্চর্য বোধহয় তখন মনের চোখে ছবি দেখি, আমার এই ছোট ভাই, একদা টলটলায়মান পায়ে আমার মায়ের দিকে এগিয়ে এসেছিল, তাঁকে আপনজনের মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, তার কোলে ওঠার জন্য। সে তো ও লোকে গিয়েছিল মায়ের বহু পূর্বে।
আমি যখন সে লোকে যাব তখন ভগবান শুধাবেন, তুমি কী চাও? আমি তৎক্ষণাৎ বলব, একখানা বাইসিকেল। পাওয়ামাত্রই তাতে ভাইকে রডে চড়িয়ে স্বর্গের লনে চক্কর লাগাব। সে খল খল করে হাসবে। মা দেখবে কিন্তু কখনও বলবে না, থাক্, হয়েছে। এখন ওকে তুই নামিয়ে দে।
***
অতএব সব বিপদ থেকেই নিষ্কৃতি আছে। গাড়ি গেছে তো তাতে ভয় পাবার অত কী?
দেখি, আবুল আসফিয়া নেই।
আমাদের এই অকূল সমুদ্র আর অন্তহীন মরুভূমির মাঝখানে ফেলে দিয়ে লোকটা পালাল নাকি?
স্টেশনের বাইরে তার খোঁজ করতে এসে দেখি, তিনি এক জরাজীর্ণ মোটরগাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে রসালাপ আরম্ভ করেছেন। অনুমান করলুম তিনি ট্যাকসিযোগে কাইরো পৌঁছবার চেষ্টাতে আছেন।
কিন্তু ট্যাকসিওয়ালা আমাদের মজ্জমান অবস্থা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছে এবং যা দর হাঁকছে তা দিয়ে দু খানি নতুন ট্যাক্সি কেনা যায়।
আবুল আসফিয়া তাকে বহুতর ধর্মের কাহিনী শোনাবার চেষ্টা করলেন, ততোধিক ভারত-মিশরীয় মৈত্রীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন এবং সর্বশেষে তিনি মুসলমান সে-ও মুসলমান, সে সত্যের দোহাই-কসম খেলেন কিন্তু ট্যাসিওয়ালাটি ধর্মে মুসলমান হলেও কর্মে খাঁটি দুর্যোধন। বিনা যুদ্ধে সে সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি এগোবে না।
আবুল আসফিয়ার চোখে-মুখে কিন্তু কোনও উষ্মর লক্ষণ নেই। ভূ-পদাহত তিতিক্ষু শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় তিনি তখন চললেন হেলথ অফিসের দিকে। আমিও পিছু নিলুম।
সেই বিরাটবপু, ভদ্রলোক, যিনি আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে প্রথম ফাড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি ততক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবার তাকে জাগাতে গিয়ে আবুল আসফিয়াকে রীতিমতো বেগ পেতে হল।
তাকে তখন তিনি যা বললেন, তার সরল অর্থ, তিনি ডাকাতকে ডরান না, ডাকাত বন্দুক উঁচালে তিনিও বন্দুক তুলতে জানেন কিন্তু এরকম বন্দুকহীন ডাকাতির বিরুদ্ধে লড়বার মতো হাতিয়ার তো তার নেই? অবশ্য তিনি ঘাবড়াননি, কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করবেনই, তবে কি না অফিসারটি যদি একটু সাহায্য করেন তবে আমাদের উপকার হয়, তারও পুণ্য হয়।
অফিসার বললেন, চলুন।
তিনি ট্যাকসিওয়ালাদের সঙ্গে দু চারটি কথা বলেই আমাদের জানালেন কত দিতে হবে। হিসাব করে দেখা গেল, গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাসে যা লাগত, ট্যাসিতে তাই লাগবে। আমরা তাতেই খুশি। কাইরো তো পৌঁছব, পোর্টসঈদে তো জাহাজ ধরতে পারব, তবে আর ভাবনা কী?