তাঁর ভাষা আমরা বুঝিনে, তিনি আমাদের ভাষা বোঝেন না। তৎসত্ত্বেও যে মারাত্মক দুঃসংবাদ তিনি দিলেন তার সরল প্রাঞ্জল অর্থ, যে ডাক্তার আমাদের পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেবেন তিনি বাড়ি চলে গেছেন।
গোটা সাতেক ভাষায় তখন যে আরব উঠল তাকে বাঙলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়–
ওই য-যা!
ফরাসিরা বলেছিল মঁ দিয়ো, মঁ দিয়ো!
জর্মনরা বলেছিল, হের গট, হের গট!
ইরানিরা বলেছিল, ইয়াল্লা, ইয়া খুদা!
আর কে কী বলেছিল, মনে নেই।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণা, আল্লাতায়ালার বেহ মেহেরবানি, রাখে কেষ্ট মারে কে, ধন্যবাদ ধন্যবাদ। শুনি অফিসার বলছেন, কিন্তু আপনারা যখন বহাল তবিয়তে, দিব্য ঘোরাফেরা করছেন তখন আপনারা নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যবান! সার্টিফিকেট আমিই দেব। এই নিন ফর্ম। ফিল্ আল্ করুন। বলেই এক তাড়া বিশ্রী নোংরা বাদামি ফরম আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার মনে হল, আহা কী সুন্দর! যেন ইস্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্ট, আর সব-কটাতে লেখা আছে আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি।
শকুনির পাল যেরকম মড়ার উপর পড়ে, আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লুম সেই গাজী মিয়ার বস্তানির উপর। উঁহু, ভুল উপমা হল, বীভৎস রসের উপমা দিতে আলঙ্কারিকরা বারণ করেছেন। তা হলে বলি, ফাঁসির হুকুম নাকচ করে দেবার অধিকার পেলে মা যেরকম নাকচের ফর্মের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উৎসাহে, উত্তেজনায় আমাদের সবাইকার মাথা তখন ঘুলিয়ে গিয়েছে। ফর্মে প্রশ্ন, কোন সালে তোমার জন্ম? কিছুতেই মনে পড়ছে না, ১৮০৪– না ১৭০৪? প্রশ্ন, কোন বন্দরে জাহাজ ধরেছে? বেবাক ভুলে গিয়েছি, হংকং না তিব্বত। প্রশ্ন, যাবে কোথায়? হায়, হায়, টাকের বাকি আড়াই গাছা চুল ছিঁড়ে ফেললুম, তবু কিছুতেই মনে পড়ছে না, শনি গ্রহে না ধ্রুবতারায়!
তা সে যাক গে, আমরা কী লিখেছিলুম তাই নিয়ে উত্তষ্ঠিত হওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। পরে জানলুম, সেই সহৃদয় অফিসারটি ইংরেজি পড়তে পারেন না।
ঝপাঝপ বেগুনি স্ট্যাম্প মেরে তিনি আমাদের গণ্ডা আড়াই সার্টিফিকেট ঝেড়ে দিলেন। আমরা সেগুলো বসরাই গোলাপের মতো বুকে খুঁজে খোলা ধোঁয়াড়ের গরুর মতো বন্দরের অফিস থেকে সুড়সুড় করে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলুম। এখন আমরা ইচ্ছে করলে কেপ করিন যেতে পারি, ইচ্ছে না করলে কোথাও যাব না।
পল বললে স্যর, কী লিখতে কী লিখেছি কিচ্ছটি জানিনে।
আমি বললুম, কিছু পরোয়া কর না ভাই! অম্মো তদবৎ!
ফরাসি রমণী হেসে বললেন, মঁসিয়ে পল, আমাকে যদি জিগ্যেস করত তুমি বকরি না মানুষ? তা হলে আমি প্রথম খানিকটে ব্যা ব্যা করে নিতুম, তার পর আপন মনে খানিকটে ফরাসি বলে নিয়ে দেখতুম কোনটা ভালো শোনাচ্ছে এবং সেই হিসেবে লিখে দিতুম বকরি না মানুষ।
তার পর খানিকটে ভেবে নিয়ে বললেন, অবশ্য বকরির সম্ভাবনাই ছিল বেশি।
আমার বুকে বড্ড বাজল। নিজের প্রতি এ যে অতিশয় অহেতুক অশ্রদ্ধা। বললুম, মাদমোয়াজেল বরঞ্চ কোকিল লিখলে আমি আপত্তি জানাতুম না। আপনার মধুর কণ্ঠ
ব্যস, ব্যস হয়েছে, হয়েছে; থ্যাঙ্ক্যু!
ততক্ষণে রেলস্টেশনের কাছে এসে পৌঁছেছি। দূর থেকে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে। আমরা পা চালালুম। কিন্তু গেটের কাছে আসতে না আসতেই ট্রেনখানা ধ্যাৎ-ধ্যাৎ করে যেন আমাদের ঠাট্টা করে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল।
এবং একটা লোক– চেনা-চেনা মনে হল আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিদায় জানালে তার পর যেন কত না বিরহ বেদনাতুর সেইভাবে দু হাতের উল্টো দিক দিয়ে অদৃশ্য অশ্রু মুছলে।
এ মস্করার অর্থ কী?
শুনলুম, আজ সন্ধ্যায় কাইরো যাবার শেষ ট্রেন এই চলে গেল। কাল সকালের ট্রেন ধরলে কাইরো মাথায় থাকুন সঈদ বন্দরে পৌঁছতে পারব না, অর্থাৎ নির্ঘাত জাহাজ মিস্ করব। এই শেষ ট্রেন ছিল আমাদের শেষ ভরসা।
এ দুঃসংবাদ শুনে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লুম।
কিন্তু ভগবান মানুষকে নিয়ে এরকম লীলা-খেলা করেন কেন? সেই যদি সুয়েজ বন্দরে আটক হতে হল, সেই যদি বোট মিস করতে হল, তবে ওই হেলথ সার্টিফিক্যেটের প্রথম খেয়াড়ে আটকা পড়লেই তো হত। সে ফাড়াকাটিয়ে এসে এখানে আবার কানমলা খাবার কী প্রয়োজন ছিল?
শুনেছি, কোনও কোনও জেলার ফাঁসির আসামিকে নাকি গারদের দরজা সামান্য খুলে রেখে জেল থেকে পালাবার সুযোগ দেয়। আসামি ভাবে, জেলার বেখেয়ালে দরজা খুলে রেখে গিয়েছে। তার পর অনেক গা ঢাকা দিয়ে, একে এড়িয়ে, ওকে বাঁচিয়ে যখন সে জেলের বাইরে মুক্ত বাতাসে এসে ভাবে সে বেঁচে গেছে, ঠিক তখনই তাকে জাবড়ে ধরে দুই পাহারাওয়ালা– সঙ্গে জেলার তাকে চুমো খেয়ে বলে, ভাই, জীবন কত দুঃখে ভরা। তার থেকে তুমি নিষ্কৃতি পাবে কাল ভোরে। আহামুখের মতো সে নিষ্কৃতি থেকে এই হেয় নিষ্কৃতির চেষ্টা তুমি কেন করছিলে, সখা?
পরদিন তার ফাঁসি হয়।
আমার মনে হয়, ফাঁসির চেয়েও ওই যে জেলের বাইরে ধরা পড়া সেটা অনেক কঠোর, কঠিন, নির্মম।
কারণ, মৃত্যু, সে তো কিছু কঠিন কঠোর অভিজ্ঞতা নয়। ডাক্তাররাও বলেন, রোগে মানুষ কষ্ট পায় কিন্তু ঠিক প্রাণত্যাগ করার সময় মানুষ কোনও বেদনা অনুভব করে না।
তাই গুরুদেব বলছেন–
কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়
জয় অজানার জয়!