শুনে পার্সি বলছে, স্যর, এসব মারাত্মক রোগেই যদি ভুগব, তবে বাপ-মার সেবাশুশ্রূষা ছেড়ে পাদ্রিসাহেবের শেষ ধর্মবচন না শুনে এখানে আসব কেন?
দ্যাশের লোক প্রতুল সেন বলছে, মিশরের সঙ্গে এরকম ধারা দুশমনি আমরা করতে যাব কেন?
তার বউ রমা বলছে, পিরামিড তোমাদের গৌরবের বস্তু; আমাদের যেরকম তাজমহল। তার কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সে বিচারের সুযোগ না দিয়ে আপনারা আপন দেশের প্রতি কী অবিচার করছেন বুঝতে পারছেন কি?
আমি কানে কানে রমাকে শুধালুম, তবে কুকের সঙ্গে যে সব লোক এসেছিল তারা পেরুল কী করে?
রমা বললে, চুপ করুন, ওরা যে ওই সব হলদে হলদে কাগজ দেখালে। আমাদেরও আছে। জাহাজে ফেলে এসেছি। আমরা তো জানতুম না এখানে ওসব রাবিশের দরকার হবে। কুকের লোক জানত, ওরা তাই সার্টিফিকেট এনেছিল।
ওহ! তখন মনে পড়ল পাসপোর্ট নেবার সময় ভ্যাকসিনেশন ইনকুলেশন করিয়েছিলুম বটে এবং ফলে একখানা হলদে রঙের সার্টিফিকেটও পেয়েছিলুম বটে। সেইটে নেই বলেই এখানে এ গর্দিশ।
কিন্তু এ শিরঃপীড়া তো আমাদের নয়। আবুল আসফিয়া যখন আমাদের দলের নেতা তখন তারই তো বোঝা উচিত ছিল ওই ম্যাটমেটে হলদে রঙের কাগজটা আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসা অতিশয় প্রয়োজনীয়। এই সামান্য কাণ্ডজ্ঞান যার নেই–
চিন্তাধারায় বাধা পড়ল। দেখি, পল আমার হাত টানছে আর কানে কানে বলছে, চলুন জাহাজে ফিরে যাই।
কিন্তু আবুল আসফিয়া কোথায়?
তিনি দেখি নিশ্চিন্ত মনে, একে সিগারেট দিচ্ছেন, ওকে টফি খাওয়াচ্ছেন, তাকে চকলেট গেলাচ্ছেন। কোলে আবার একটা বাচ্চা। খোদায় মালুম কার?
লোকটা তা হলে বদ্ধ পাগল! পাগলের সংস্পর্শ ত্যাগ করাই ধৰ্মাদেশ।
পলের হাত ধরে পোর্ট-আপিস ছেড়ে সমুদ্রের কিনারায় পৌঁছলুম। তখন দেখি আমাদের জাহাজ ভোঁ ভোঁ করে গুরুগম্ভীর নিনাদে সুয়েজ খালে ঢুকে গিয়েছে।
১৫. দেশভ্রমণ আমি বিস্তর করেছি
১৫.
দেশভ্রমণ আমি বিস্তর করেছি। সামান্য কিছু ঘটতে না ঘটতেই আমি বিচলিত হয়ে পড়িনে। রিফ্রেশমেন্ট রুমে চা খেতে গিয়েছি, ওদিকে গাড়ি আমার বাক্স-তোরঙ্গ বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে গিয়েছে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে মানিব্যাগ চুরি যাওয়াতে আমি কপর্দকহীন, ইতালির এক রেস্তোরাঁয় দুই দলে ছোরা-ছুরি হচ্ছে– আমি নিরীহ বাঙালি এক কোণে দেয়ালের চুনকামের মতো হয়ে গিয়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করছি– এসব ঘটনা আমার জীবনে একাধিকবার ঘটেছে। কিন্তু এবার সুয়েজ বন্দরে, আবুল আসফিয়ার পাল্লায় পড়ে যে বিপদে পড়লুম তার সঙ্গে অন্য কোনও গর্দিশের তুলনা হয় না।
আমাদের জাহাজ তার আপন পথে চলে গিয়েছে। আমরা এখানে আটকা পড়েছি হেলথ সার্টিফিকেট নেই বলে। তা হলে এখানকার কোনও হোটেলে উঠতে হয় এবং প্রতি জাহাজে ধন্না দিতে হয়, আমাদের জায়গা দেবে কি না। খুব সম্ভব দেবে না। কারণ সেই পোড়ামুখো হেলথ সার্টিফিকেট না থাকলে জাহাজেও উঠতে দেয় না। এস্থলে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ নয় এখানে জলে সাপ ডাঙায়ও সাপ।
জাপানি আক্রমণের সময়ে একটা গাঁইয়া গান শুনেছিলুম,
সা রে গা মা পা ধা নি
বোমা পড়ে জাপানি
বোমা-ভরা কালো সাপ
ব্রিটিশ কয় বাপ রে বাপ!
তাই মনে হল জাপানিরা যেন জলে-ডাঙায়, উভয়ত হেলথ সার্টিফিক্যেটের সাপ ফেলে গেছে।
আর ডাঙার হোটেলে থাকতে দেবেই-বা কদিন? আমাদের ট্যাকে যা কড়ি তার খবর হোটেলওয়ালা ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পেরে নিশ্চয়ই আমাদের দুদূর করে তাড়িয়ে দেবে। তখন যাব কোথায়, খাব কী? তখন অবস্থা হবে সুয়েজ বন্দরের ধনী-গরিব সক্কলের কাছে ভিখ মাঙবার, কিন্তু কেউ কিছু দেবে কি? রেল ইস্টিশনে যখন কেউ এসে বলে, মশাই মানিব্যাগ চুরি গিয়েছে; চার গণ্ডা পয়সা দিন, বাড়ির ইস্টিশানে যেতে পারব, তখন কি কেউ শোনামাত্রই পয়সা ঢালে?
ইয়া আল্লাহ এ কোথায় ফেললে বাবা? এ যেন অকূল সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপবাস।
মানুষ যখন ভেবে কোনওকিছুর কূলকিনারা করতে পারে না তখন অন্যের ওপর নির্ভর করার চেষ্টা করে। পল-পার্সিকে নিয়ে ফিরে গেলুম আবুল আসফিয়ার কাছে।
তিনি দেখি ঠিক সেই মুহূর্তেই পোর্ট অফিসারকে শুধাচ্ছেন, তা হলে হেলথ সার্টিফিকেট কোথায় পাওয়া যায়?
এ যেন পাগলের প্রশ্ন! হেল্থ সার্টিফিকেট তো পাওয়া যায় আপন দেশে; এখানে পাব কী করে?
তাই আপন কানকে বিশ্বাস করতে পারলুম না যখন অফিসার বললেন, কেন ওই তো পাশের দফতরে।
তাহলে এতক্ষণ ধরে এসব টানাহ্যাঁচড়ার কী ছিল প্রয়োজন? ভালো করে শোনার পূর্বেই আমরা সব কটা প্রাণী ছুট দিলুম সেই দফতরের দিকে। জলের সাপ, ডাঙার সাপ, সা-রে-গা-মার জাপানি সাপ সব-কটা তখন এক জোটে যেন আমাদের তাড়া লাগিয়েছে।
দফতরের দরওয়াজা খোলাই ছিল। দেখি এক বিরাট বপু ভদ্রলোক ছোট্ট একখানা চেয়ারে তার বিশাল কলেবর খুঁজে-পুরে টেবিলের উপর পা দুখানি তুলে ঘুমুচ্ছেন। আমরা অট্টরোল করে না ঢুকলে নিশ্চয়ই তাঁর নাকের ফরফরানি শুনতে পেতুম। আমাদের হেলথ সার্টিফিকেট হেলথ সার্টিফিকেট, প্লিজ, প্লিজ, এ উৎকট সমবেত সঙ্গীতে অবশ্য ইয়োরোপীয় সঙ্গীত, যার এ সপ্তকে বাজে তোড়ি অন্য সপ্তকে পূরবী ভদ্রলোক চেয়ারসুদ্ধ লাফ মেরে উঠলেন।
শতকরা নিরানব্বই জন যাত্রী হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে বন্দরে নামে। সুতরাং এ ভদ্রলোকের শতকরা নিরানব্বই ঘণ্টাই কাটে আধো ঘুমে, আধো জাগরণে। তাই আমরা কী বেদনা-কাতর হয়ে তার কাছে এসেছি সেটা বুঝতে তার বেশ একটু সময় লাগল।