ফলে কী হল? পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজ সমুদ্রপথেই মোগলদের মুণ্ডু কেটে এদেশে রাজ্য বিস্তার করল।
সেকথা পরের কথা। উপস্থিত আমরা আলোচনা করছি, ভারতীয় উপকূলবাসীরা পর্তুগিজদের সঙ্গে যে লড়াই দিয়েছিল তাই নিয়ে। এরা তো মোগলদের কাছ থেকে কোনও সাহায্যই পেল না, উল্টো যারা লড়ছিল, তাদের সঙ্গে আরম্ভ করলেন শক্রতা।
গুজরাতের রাজা বাহাদুর শাহ্ বাদশাহ তখন লড়ছিলেন পর্তুগিজ বোম্বেটেদের সঙ্গে। তার প্রধান কারণ, গুজরাতের সুরাট, ব্রউফ (ভৃগু, খন্বত Cambay, স্তম্ভপুরী) ভিতর দিয়ে উত্তর-ভারতের যাবতীয় পণ্যবস্তু ইয়োরোপে যেত। সে ব্যবস্থা তখন পর্তুগিজ বোম্বেটেদের অত্যাচারে মরমর। বাহাদুর শাহ্ বাদশার দুই শক্র। একদিকে সমুদ্রপথে পর্তুগিজ, অন্যদিকে স্থলপথে রাজপুত। প্রথম রাজপুতদের হারিয়ে দিয়ে পরে পর্তুগিজদের খতম করার প্ল্যান করে তিনি পর্তুগিজদের সঙ্গে করলেন– আর্মিসি-সমরকালীন সন্ধি। তার পর হানা দিলেন রাজপুতনায়।
দিল্লিতে তখন রাজত্ব করেন বাদশা হুমায়ুন। ইতিহাসে নিশ্চয়ই পড়েছ, তখন এক রাজপুতানি শাহ-ইন-শাহ দিল্লীশ্বর জগদীশ্বরকে পাঠালেন রাখী। সেই রাখীর সম্মানার্থে হুমায়ুন ছুটলেন রাজপুতনার দিকে। বুঝলেন না, বাহাদুর শাহ্ হেরে গেলে পর্তুগিজদের আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। পূর্বেই বলেছি, নৌবহর নৌসাম্রাজ্য বলতে কী বোঝায়, মোগলরা সেকথা আদপেই বুঝত না।
হুমায়ুন রাজপুতনায় পৌঁছলেন দেরিতে। বাহাদুর শাহ বাদশাহ তখন রাজপূতনা জয় করে ফেলেছেন। রাজপুতানিরা জৌহতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। হুমায়ুন তখন আক্রমণ করলেন বাহাদুর শাহকে। বাহাদুর তখন পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন চম্পানির দুর্গে। সেখানে কী করে হুমায়ুন দুর্গ জয় করলেন সে কাহিনী অবশ্য ইতিহাসে পড়েছ। ইতোমধ্যে বাহাদুর দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়েছেন গুজরাতে আপন রাজধানী আহমেদাবাদের দিকে। হুমায়ুন সেদিকে তাড়া লাগাতে তিনি পালালেন সৌরাষ্ট্র অর্থাৎ কাঠিওয়াড়ারের দিকে। সেখানকার কোনও কোনও উপকূলে তখন পর্তুগিজরা বেশ পা জমিয়ে বসেছে।
ইতোমধ্যে হুমায়ুন খবর পেলেন, বিহারের রাজা শেরশাহ দিল্লি জয় করার উদ্দেশ্যে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তদ্দণ্ডেই তিনি বাহাদুরকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে চললেন দিল্লির দিকে। সেখানে শেরশাহের কাছে মার খেয়ে তিনি পালালেন কাবুলে। তার পর শের শাহ ব্যস্ত হয়ে রইলেন, উত্তর-ভারতে আপন প্রতিষ্ঠা কায়েম করতে। বাহাদুরকে তাড়া দেবার ফুরসত তার নেই। বাহাদুর হাঁফ ছেড়ে বেঁচে বললেন, এইবার তবে পর্তুগিজ বদমায়েশদের ঠাণ্ডা করি। পর্তুগিজরা ততদিনে বুঝতে পেরেছে, বাহাদুরের পিছনে তখন আর শত্রু নেই তাই তারা আরম্ভ করল তাদের পুরনো বদমায়েশি। বাহাদুর শাহকে আমন্ত্রণ জানাল, তাদের জাহাজে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য সন্ধি-চুক্তি সম্বন্ধে যাবতীয় আলোচনা-পরামর্শ করার জন্য।
বাহাদুর আহাম্মুখের মতো কেন গেলেন সেই নিয়ে বিস্তর ঐতিহাসিকগণ বহু আলোচনা-গবেষণা করেছেন। সে নিয়ে আজ আর আলোচনা করে কোনও লাভ নেই।
তা সে যাই হোক, একথা কিন্তু সত্য, বাহাদুর জাহাজে ওঠামাত্রই বুঝতে পারলেন, তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন। পর্তুগিজদের বদমতলব তাঁকে খুন করার, তাঁর সঙ্গে সন্ধি সুলেহ করার জন্য নয়। তক্ষুনি তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে সাঁতরে পাড়ে ওঠার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে দশ-বিশটা পর্তুগিজও হাতে বৈঠা নিয়ে তার পিছনে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেইসব বৈঠা দিয়ে গুজরাতের শাহ্-ই-শাহ্ বাদশাহ্ বাহাদুর শাহের মাথা ফাটিয়ে দিলে।
পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের এই শেষ লড়াই।
***
কিন্তু আজ সুয়েজ বন্দরে ঢোকার সময় আমি দেশ পানে ফিরে গিয়ে এসব কথা পাড়ছি কেন?
কারণ এই সুয়েজের রাজাকেই বাহাদুর তখন ডেকেছিলেন তার নৌবাহিনী নিয়ে এসে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে তাঁকে নৌ-সমরে সাহায্য করতে। পূর্বে বলেছি, সুয়েজও বেশ জানত পর্তুগিজদের বোম্বেটেগিরি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতখানি মারাত্মক। শুধু বাহাদুর নয় তাঁর পূর্বপুরুষগণও বার বার এঁদের ডেকেছেন। দুয়ে মিলে পর্তুগিজদের একাধিকবার ঝিঙে-পোস্ত চন্দন-বাটা করেছেন।
তারা তখন যেসব কামান এনেছিল সেগুলো ফেরত নিয়ে যায়নি। গুজরাতের বাদশা যখন বললেন, এগুলো রেখে যাচ্ছেন কেন? তখন তারা বলেছিল, এইসব পর্তুগিজ বদমায়েশরা আবার কখন হানা দেবে তার ঠিকঠিকানা কী? আবার তখন কামান নিয়ে আসার হাঙ্গাম হুজ্জোত ঠেলবার কী প্রয়োজন?
এ ঘটনার দশ বৎসর পর আকবর গুজরাত জয় করেন। তিনি কামানগুলো দেখে তাদের পূর্ববর্তী ইতিহাস জেনেও নৌবাহিনী নৌ-সমরের মূল্য বুঝতে পারেননি। তাই পর্তুগিজরা জিতল। তাদের হারিয়ে দিয়ে ইংরেজ জিতল। ক্রমে ক্রমে মাদ্রাজ কলকাতা হয়ে তাবৎ ভারতবর্ষে আপন রাজ্য বিস্তার করল।
***
আজ সুয়েজে ঢুকে সেই কথাই স্মরণে এল, এই সুয়েজের লোকই একদিন আমাদের সঙ্গে একজোট হয়ে পর্তুগিজ বর্বরতার বিরুদ্ধে কী লড়াই-ই দিয়েছিল।
.
১৪.
সম্বিতে ফিরে এলুম। দেখি বখেড়া লেগে গিয়েছে। বন্দরে নেমে যে দপ্তরের ভিতর দিয়ে যেতে হয় সেখানে আমাদের অর্থাৎ আবুল আসফিয়ার দলকে আটকে দিয়েছেন বন্দরের কর্তারা। কেন কী ব্যাপার? আমাদের হেলথ সার্টিফিকেট কই? সে আবার কী জ্বালা? দিব্যি তো বাবা লঞ্চ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এখানে এলুম, স্ট্রেচারে চেপে কিংবা মড়ার খাঁটিয়ায় শুয়ে আসিনি তবে আমাদের হেলথ সম্বন্ধে এত সন্দ কেন? উঁহু, কর্তারা বলছেন আমরা যে ভিতরে ভিতরে বসন্ত, প্লেগ, কলেরা, সেৎসেত সে জ্বর (সে আবার কী মশাই?) স্পটেড ফিভার (ততোধিক, সমস্যা আলপনা-কাটা জ্বর?) ইত্যাদি যাবতীয় মারাত্মক রোগে ভুগছি না তার সার্টিফিকেট কই। আমরা যে এসব পাপিষ্ঠ রোগ তাদের সোনার দেশ মিশরে ছড়াব না, তার কি জিম্মাদারি?