দুম করে ধাক্কা লাগতে সংবিতে ফিরে এলুম। লঞ্চ পাড়ে লেগেছে। কিন্তু এরকম ধাক্কা লাগায় কেন? আমাদের গোয়ালন্দ-চাঁদপুরে তো এরকম বেয়াদবি ধাক্কা দিয়ে জাহাজ পাড়ে ভিড়ে না!
আবার!
সেই পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,
দেশ পানে মন ধায়।
.
১৩.
সুয়েজ বন্দর কিছু ফেলনা বন্দর নয়। বন্দরটার সামরিক গুরুত্ব স্ট্রাটেজিক ইম্পর্টেনস– আছে বলে ইংরেজকে তার নৌবহরের একটা অংশ এখানে রাখতে হয়। যেসব গোরাদের ক্যাম্বিসের নৌকোয় করে জলকেলি করতে দেখেছিলুম তারাই এইসব নৌবহরের তদারকি করে। ফলে তাদের জন্য এখানে দিব্য একটা কলোনি গড়ে উঠেছে।
কিন্তু কিছুই নয়, কিছুই নয়, পূর্বের তুলনায় আজ সুয়েজ বন্দরের কী আর জমক জৌলুস! কেপ অব গুড হোপের পথ না বেরুনো পর্যন্ত, এমনকি তার পরও ভারতবর্ষ, বার্মা, মালয়, যবদ্বীপ, চীন থেকে যেসব জিনিস রপ্তানি হত তার অধিকাংশই সমুদ্রপথে এসে নামত সুয়েজ বন্দরে এবং ভুললে চলবে না, তখনকার দিনে প্রাচ্যই রপ্তানি করত বেশি। এখান থেকেই ফিনিশিয়ানরা, তার পরে গ্রিক, তার পর রোমান, তার পর আরবরা ভারতের দিকে রওনা হত। ভারত থেকে মাল এনে সুয়েজে নামানো হত। সুয়েজ থেকে একটা খালে করে এসব মাল যেত কাইরোতে এবং সেখান থেকে নীল নদ বয়ে সে মাল পৌঁছত আলেকজেনড্রিয়ায় আরবিতে যাকে বলে ইসকনদরিয়া। সেখান থেকে ভেনিসের মাধ্যমে তাবৎ ইউরোপ।
এইসব মাল কেনাকাটা আমদানি-রপ্তানিতে ভারতবর্ষের প্রচুর সদাগর-শ্ৰেষ্ঠী, মাঝি-মাল্লার বিরাট অংশ ছিল। যে যুগে ভাস্কো-দা-গামা এ পথকে নাকচ করে দেবার জন্য আফ্রিকা ঘুরে ভারতে আসার পথ বের করলেন সে যুগের পূর্বে প্রাচ্যের তাবৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ভারতীয় এবং সুয়েজ অঞ্চলের মিশরীয়দের হাতে।
একদিকে ভারতীয় এবং মিশরীয়; অন্য দিকে ভাস্কো-দা-গামার বংশধর পর্তুগিজ দল।
জাত তুলে কথা কইতে নেই, তাই ইশারা-ইঙ্গিতে কই। এই যে পর্তুগিজ গুণ্ডারা গোয়া নিয়ে আজ দাবড়াদাবড়ি করছে এ কিছু নতুন নয়। ওদের স্বভাব ওই। এক কালে তারা জলে বোম্বেটে ছিল, এখন তারা ডাঙার গুণ্ডা। বোম্বেটে শব্দের মূল আর অর্থ অনুসন্ধান করলেই কথাটা সমপ্রমাণ হবে। বোম্বেটে কিছু বাঙালিদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বানানো আজগুবি কথা নয়। বোম্বেটে শব্দ এসেছে ওই পর্তুগিজদের ভাষা থেকেই (bombardeiro), অর্থাৎ যারা না-বলে না-কয়ে যত্র-তত্র bomba)– বোমা ফেলে। হয়তো বলবে, আমাদের কলকাতাতেই কেউ কেউ এরকম বোমা ফেলে থাকে, কিন্তু তাদের সংখ্যা এতই নগণ্য এবং ঘৃণ্য যে আজ তাবৎ কলকাতাবাসীকে কেউ বোম্বেটে নাম দেয়নি। কিন্তু তাবৎ পর্তুগিজরাই এই অপকর্ম করত বলে তাদের নাম হয়ে গেল বোম্বেটে।
ওদের দ্বিতীয় নাম—-আমাদের বাঙলা ভাষাতেই হারমদ সেটাও পর্তুগিজ কথা ama da থেকে এসেছে। বিখ্যাত কোষকার স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার সুবিখ্যাত অভিধানে এ শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেছেন, পর্তুগিজ জলদস্যুরা যখন বাঙলা দেশের সুন্দরবন অঞ্চলে প্রথম হানা দেয় তখন তাদের অসহ্য অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালিরা সুন্দরবন অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমাদের ঘরোয়া কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে আছে–
ফিরিঙ্গির দেশখান বাহে কর্ণধারে।
রাত্রিতে বহিয়া যায় হারমদের ডরে ॥
অর্থাৎ এইসব হারমদ–amada বোম্বেটে bombardeiro-দের ডরে তখন দক্ষিণ বাঙলার লোক নিশ্চিত মনে ঘুমুতে পারত না।
এস্থলে যদিও অবান্তর, তবু প্রশ্ন, বাঙালিরা এত ভয় পেয়ে পালাল কেন?
উত্তরে বলি, যে কোনও বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে, একপাল লোক সেটাকে লুটতরাজ করতে পারে। এটা আদপেই কোনও কঠিন কর্ম নয়, যদি,
এইখানেই এক বিরাট যদি–
যদি সে রাজা তার সমুদ্রকূল রক্ষার জন্য নৌবহর মোতায়েন না করেন। জনপদ রক্ষা করার জন্য যেরকম পুলিশ-সেপাই রাজাকেই রাখতে হয়, ঠিক তেমনি সমুদ্রকূলবাসীদের হেপাজতির জন্য রাজাকেই নৌবহর রাখতে হয়।
কিন্তু হায়, তখন বাঙলা দেশ হুমায়ুন, আকবর মোগল বাদশাদের হুকুমে চলে। মোগলরা এদেশে এসেছে মধ্য এশিয়ার মরুভূমি থেকে। তারা শক্ত মাটির উপরে খাড়া পদাতিক, অশ্ববাহিনী, হস্তিযূথ, স্ত্রবাহিনী চতুরঙ্গ সৈন্যসামন্তের কী প্রয়োজন সে তত্ত্ব বিলক্ষণ বোঝে, কিন্তু নৌবহর রাখার গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন। বাঙলা, উড়িষ্যা গুজরাত থেকে তাদের কাছে অনেক করুণ আবেদন-নিবেদন গেল–হুঁজুরেরা দয়া করে একটা নৌবহরের ব্যবস্থা করুন; না হলে আমরা ধনে-প্রাণে মানে-ইজ্জতে গেলুম।
কথাগুলো একদম শব্দার্থে আঁটি। ধন গেল, কারণ পর্তুগিজ বোম্বেটেদের অত্যাচারে ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। প্রাণ যায়, কারণ তারা বন্দরে বন্দরে লুটতরাজের সময় যেসব খুনখারাবি করে তারই ফলে বন্দরগুলো উজাড় হতে চলল। মান-ইজ্জত? ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পর্তুগালের হাটবাজারে গোলাম বাদি, দাসদাসীরূপে বিক্রয় করছে।
কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! মোগল বাদশারা বসে আছেন পশ্চিম পানে, খাইবার পাসের দিকে তাকিয়ে। ওই দিক থেকেই তারা এসেছেন স্বয়ং, তাদের পূর্বে এসেছে পাঠান শক্-হুঁ-সিথিয়ান-এরিয়ান। তাই তাঁরা তৈরি করেছেন চতুরঙ্গ। ওদের ঠেকাবার জন্য। নৌবহর চুলোয় যাক গে। ভারতবর্ষ তো কখনও সমুদ্রপথে পরাজিত এবং অধিকৃত হয়নি। তার জন্য বৃথা দুশ্চিন্তা এবং অযথা অক্ষয় অতিশয় অপ্রয়োজনীয়।