বিবেচনা করলুম, এই সুটে আঠারোটা পকেট নেই বলে তিনি পোর্টফোলিয়োতে টফি চকলেট, সিগার সিগারেট ভর্তি করেছেন।
সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ঘন নীলাকাশ কেমন যেন সূর্যের লাল আর আপন নীলে মিলে বেগুনি রঙ ধরতে আরম্ভ করলে। তারই আভাতে লাল দরিয়ার আনীল জলে ফিকে বেগুনি রঙ ধরে নিচ্ছে। ভূমধ্যসাগর থেকে একশো মাইল পেরিয়ে আসছে মন্দমধুর ঠাণ্ডা হাওয়া। সে হাওয়া লাল দরিয়ার এই শেষ প্রান্তে তুলেছে ছোট ছোট তরঙ্গ। তারই উপর দিয়ে দুলে দুলে আসছে আমাদের স্টিমলঞ্চ। তার রঙ আসলে সাদা কিন্তু এই লাল-বেগুনির পাল্লায় পড়ে তারও রঙ যেন বেগুনি হতে আরম্ভ করলে।
স্টিমলঞ্চটি শুভ্রপুচ্ছ রাজহংসবৎ। রাজহাঁস সাঁতার কেটে যাবার সময় যেরকম শুভ্র বীচিতরঙ্গ জাগিয়ে তোলে, এ তরণীটিও তেমনি প্রপেলারের তাড়নায় জাগিয়ে তুলছে। শুভ্র ফেননিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য চক্রাবর্ত। বড় জাহাজের বিরাট প্রপেলার যখন এরকম আবর্ত জাগায় তখন সেদিকে তাকাতে ভয় করে, মনে হয় ওই দয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই কিন্তু ক্ষুদ্র লঞ্চের ছোট্ট ছোট্ট দয়ের একটি সরল মাধুর্য আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায়।
সূর্য অস্ত গেল মিশর মরুভূমির পিছনে। পদ্মার সূর্যাস্ত, সমুদ্রের সূর্যাস্ত যেমন আপন আপন বৈশিষ্ট্য ধরে ঠিক তেমনি মরুভূমির সূর্যাস্তও এক দর্শনীয় সৌন্দর্য। সোনালি বালিতে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সেটা আকাশের বুকে হানা দেয় এবং ক্ষণে ক্ষণে সেখানকার রঙ বদলাতে থাকে। তার একটা রঙ ঠিক চেনা কোনও জিনিসের রঙ সেটা বুঝতে না বুঝতে সে রঙ বদলে গিয়ে অন্য জিনিসের রঙ ধরে ফেলে। আমাদের কথা বাদ দাও, পাকা আর্টিস্টরা পর্যন্ত এই রঙের খেলা দেখে আপন রঙের পেলেটের দিকে তাকাতে চান না।
সুয়েজ বন্দরে ইংরেজ সৈন্যদের একটি ঘাটি আছে, তাই রবিঠাকুরের ভাষায় বড় সায়েবের বিবিগুলো নাইতে নেমেছে। কেউ কেউ আবার ছোট্ট ছোট্ট নৌকো করে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করছে। নৌকোগুলো হালফ্যাশনের ক্যাম্বিসে তৈরি। নৌকোর পাঁজর ভেনেস্তা কাঠের দড় শলা দিয়ে বানিয়ে তার উপর ক্যা এজাতীয় নৌকো কলাপসিবল-পোর্টেবল অর্থাৎ নৌভ্রমণের পর ভেনেস্তার পাঁজর আর ক্যাম্বিসের চামড়া আলাদা আলাদা করে নিয়ে, ব্যাগের ভিতর প্যাক করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। ওজন দশ সেরের চেয়েও কম। পরিপাটি ব্যবস্থা। অবশ্য নৌকোগুলো খুব ছোট। দু জন মুখোমুখি হয়ে কায়ক্লেশে বসতে পারে। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে জল বাঁচিয়ে টুকিটাকি জিনিস রাখার ব্যবস্থা আছে। একজোড়া, গুণী দেখি সেখানে একটা পোর্টেবলের উপর রেকর্ড লাগিয়েছে ব্লু ডানয়্যুবের!
ওই তো মানুষের স্বভাব, কিংবা বলব বজ্জাতি। যেখানে আছে সেখানে থাকতে চায় না। যে জোড়া র ডানয়ুব বাজাচ্ছে তাদের যদি এক্ষুণি ডানয়ুব নদীর উপর ভাসিয়ে দাও তবে তারা গাইতে শুরু করবে, মাই হার্ট ইজ ইন দি হাইল্যান্ড, মাই হার্ট ইজ নট হিয়ার।
তাকে যদি তখন তুমি স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডে নিয়ে যাও তবে সে গাইতে আরম্ভ করবে, ইম, রোজেন-গানে ফন্ সাঁসুসি অর্থাৎ সাসুসির গোলাপবাগানে–সাসুসি পদামে, বার্লিনের কাছে। তখন যদি তুমি তাকে বার্লিন নিয়ে যাও তবে সে গাইতে আরম্ভ করবে ভারতবর্ষের গান। জর্মানির বড় কবি কী গেয়েছেন শোনো,
গঙ্গার পার– মধুর গন্ধ ত্রিভুবন আলো ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতি-ধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
আম্ গাঙ্গোস ডুফটেটস লয়েস্টট
উনট রিসেনবয়মে ব্ল্যুয়েন,
উন্ট শোনে, স্টিলে মেনশেন
ফর লটসব্লুমেন ক্লিয়েন।
এবং সেখানে যখন মন ওঠে না তখন গেয়ে ওঠেন স্বপ্নপুরীর গান, যে পুরী কেউ কখনও দেখেনি, যার সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ জনের কোনওই পরিচয় নেই, কবিরাই শুধু যাকে মর্ত্যলোকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন–
কোথা হায় সেই আনন্দনিকেতন?
স্বপ্নেই শুধু দেখি সে ভুবন আমি,
রবির এল, কেটে গেছে হায়, যামী
ফেনার মতন মিলে গেল এ স্বপন।
আখ ইয়েনসে লান্ট ডের ভনে,
ডাস্ জে ই অফ ইম্ ট্রাউম,
ডখ কমট ডি মর্গেনজনে,
ফেরফ্লিস্টস্ ভি আইটেলশাউম্।
আমি কিন্তু যেখানে আছি সেখানেই থাকতে ভালোবাসি। নিতান্ত বিপদে না পড়লে আমি আপন গা ছেড়ে বেরুতে রাজি হইনে। দেশভ্রমণ আমার দু চোখের দুশমন। তাই যখন রবিঠাকুর আপন ভূমির গান গেয়ে ওঠেন তখন আমি উদ্ধাহু হয়ে নৃত্য আরম্ভ করি।
শোনো–
তোমরা বল, স্বর্গ ভালো
সেথায় আলো
রঙে রঙে আকাশ রাঙায়
সারা বেলা।
ফুলের খেলা
পারুল ডাঙায়!
হক না ভালো যত ইচ্ছে–
কেড়ে নিচ্ছে
কেউ বা তাকে বলল, কাকী?
যেমন আছি
তোমার কাছেই
তেমনি থাকি!
ঐ আমাদের গোলাবাড়ি
গোরুর গাড়ি
পড়ে আছে চাকা ভাঙা,
গাবের ডালে
পাতার লালে
আকাশ রাঙা।
সন্ধেবেলায় গল্প বলে
রাখো কোলে
মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি।
চালতা-শাখে
পেঁচা ডাকে।
বাড়ে রাতি।
স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি
বলছি, কাকী,
দেখব আমায় কে কী করে।
চিরকালই
রইব খালি
তোমার ঘরে।
এ ছেলে তার কাকিমার কোলে বসে গলা জড়িয়ে যা বলেছে সে-ই আমার প্রাণের গান, তাতে আমার সর্ব দেহ-মন সাড়া দেয়। বিস্তর দেশভ্রমণের পর আমি তাই এই ধরনের একটি কবিতা লিখেছিলুম। কত না ঝুলোঝুলি, তারও বেশি ধন্নে দেবার পরও যখন কোনও সম্পাদক সেটা ছাপাতে রাজি হননি– বসুমতীর সম্পাদকও তাঁদেরই একজন– তখন তোমাদের ঘাড়ে আজ আর সেটা চাপাই কোন অধম বুদ্ধিতে?