.
১১.
পরদিন নিদ্রাভঙ্গে কেবিন ছেড়ে উপরে আসতেই দেখি হৈ-হৈ-রৈরৈ কাণ্ড! একদল লোক আবুল আসফিয়াকে ঘিরে নানারকমের প্রশ্ন শুধোচ্ছে। কুক কোম্পানি কাইরো দেখবার জন্য চায় একশো টাকা আর আপনি বলেন, পঞ্চাশ টাকাতেই হয়, সেটা কী প্রকারে সম্ভব? আরেক দল বলে, তারাও আসতে রাজি কিন্তু যদিস্যাৎ কোনও প্রকারের গড়বড় সড়বড় হয়ে যায় আর তারা জাহাজ না ধরতে পারে তখন যে ভয়ঙ্কর বিপদ উপস্থিত হবে তার কী সমাধান?
অর্থাৎ ইতোমধ্যে আমাদেরই মতো আমাদের গরিব সহযাত্রীরা জেনে গিয়েছে সস্তাতেও কাইরো এবং পিরামিড দেখা যায়। কাজেই এখন আর পল, পার্সি, আমি, এই ত্রিমূর্তি, এবং আবুল আসফিয়াকে নিলে চতুর্মুখ– এখন আর তা নয়, এখন সমস্যাটা সহস্রনয়না হয়ে গিয়েছে, জনগণমন সাড়া দিয়েছে।
আবুল আসফিয়া কেবল মাঝে মাঝে বলেন, হো জায়গা, সব কুছ হো জায়গা।
হিন্দুস্তানি বলছেন কেন? তিনি তো ইংরেজি জানেন। তখন লক্ষ করলুম যেসব দল তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদের ভিতর রয়েছে ফরাসি, জর্মন, স্পেনিশ, রুশ আরও কত কী? এরা সবাই বোঝে, এমন কোনও ভাষা ইহসংসারে নেই। তাই তিনি নিশ্চিন্ত মনে মাতৃভাষায় কথা বলে যাচ্ছেন। ইংরেজি বললে যা, হিন্দুস্তানি বললেও তা। ফল একই।
এমন সময় আমাদের দলের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা মধুর এবং দরদভরা গলায় বললেন, মসিয়ো আবুল, যদি কোনও কারণে আমরা জাহাজ মিস করি তখন যে আমরা মহা বিপদে পড়ব। আপনি তো আমাদের কাউকে তার অনিচ্ছায় জোর করে নিয়ে যাচ্ছেন না যে আপনাকে জিম্মাদার হতে বলব।
ক্লোদেৎ শেনিয়ের যা বললেন, তার মোটামুটি অর্থ, আপনি যে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার জিম্মাদারি আপনার নয়, কিন্তু যদি কোনওরকমের বিপর্যয় উপস্থিত হয় তবে তার গুরুত্বটা আপনি ভালো করে বিবেচনা করে দেখলে হয় না কি?
উপস্থিত সকলের মনোভাব মহিলাটি যেন অতি ললিত ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। সবাই চিৎকার করে সায় দিল আপন আপন ভাষায়।
ফরাসি দল– উঁই উঁই,
জর্মন দল–ইয়া ইয়া,
ইতালীয় দল– সি সি,
একটি রাশান–দা দা,
গুটিকয়েক ভারতীয়– ঠিক হৈ ঠিক হৈ,
পল-পার্সি–-ইয়েস ইয়েস,
আমি নিজে কিছু বলিনি– কিন্তু সেকথা যাক।
আবুল আসফিয়া উত্তরে ঘাড় নিচু করে বললেন, মৈ জিম্মেদার হুঁ।
তাকে যদিও কেউ জিম্মেদার হবার শর্ত চায়নি তবু তিনি জিম্মাদার, এটা সম্পূর্ণ। তাঁরই দায়িত্ব!
.
১২.
চাকরির সন্ধানে গিয়ে এক বাঙালি বড় সাহেব ইংরেজকে খুশি করার জন্য বলেছিল, হুজুর, আপনার বাঙলোতে আসবার জন্য ভয়ের চোটে পা আর ওঠে না। যদি এক পা এগোই তো তিন কদম পিছিয়ে যাই। বড় সায়েব মাত্রই যে গাধা হয় তা নয়– এ সায়েবের বুদ্ধি ছিল। বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই শুধাল, তা হলে এখানে পৌঁছলে কী করে? সায়েব যে বাবুর বিনয় বচন এতখানি শব্দার্থে নেবেন বেচারী সেটা অনুমান করতে পারেনি। প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু চাকরির ফিকিরে বাঙালির কাছে কোনও কসরত কোনও কৌশল অজানা নেই। একটিমাত্র শুকনো টোক না গিলেই বললে, হুজুর, তাই আমি আপন বাড়ির দিকে মুখ করে চলতে আরম্ভ করলুম, আর এই দেখুন দিব্যি হুজুরের বাঙলোতে পৌঁছে গিয়েছি।
গল্পের বাকিটা আমার মনে নেই, তবে আবুল আসফিয়ার কাইরো ভ্রমণ প্রস্তাবে উমেদাররা যদি এক পা এগোন তবে তিন পা পিছিয়ে যান। পল, পার্সি আর আমি ছাড়া কেউই পাকাপাকি কথা দেন না, আমাদের পার্টিতে আসছেন কি না। অথচ ঘড়িঘড়ি তরো-বেতরো প্রশ্ন। গাড়ি যদি মিস্ করি, কাইরোতে হোটেলে যদি জায়গা না মেলে, যদি রাত্রিবেলা হয় আর আকাশে চাঁদ না থাকে তবে পিরামিড দেখব কী করে আরও কত কী বিদঘুঁটে সব প্রশ্ন। ওদিকে আবুল আসফিয়া আপন কেবিনে খিল দিয়ে শুয়ে আছেন। প্রশ্নের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে আমাদেরই আমরা যেন ইংলন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের ভারতীয় ভাইয়! শেষটায় আমরাও গা-ঢাকা দিতে আরম্ভ করলুম।
সন্ধের ঝোঁকে জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছল। সুয়েজ খালের মুখে এসে জাহাজ নোঙর ফেলতেই ডাঙা থেকে একটা স্টিমলঞ্চ এসে জাহাজের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তখন জানা গেল আবুল আসফিয়ার দলে সবসুদ্ধ আমরা নজন যাচ্ছি। তাঁকে নিয়ে দশ জন।
কুকের গাইড স্টিমলঞ্চে করে ডাঙা থেকে জাহাজে এসেছিল। দেখলুম, তার দলে বারো জন যাত্রী। তা হলে আমাদের দশ জন এমন মন্দ কী!
গাইড চড়চড় করে সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে নামল– পিছনে পিছনে তার দলের বারো জন নামল পাণ্ডা– গোরুর ন্যাজ ধরে পাপী যেরকম ধারা বৈতরণী পেরোয়। আমাদের আবুল আসফিয়াও চচ্চড় করে নামলেন যেন কত যুগের ঝানু গাইড!
কুকের গাইড এরকম ব্যাপার আগে কখনও দেখেনি। তার তদ্বিরি জিমেদারি উপেক্ষা করে একপাল লোক চলেছে আপন গোঠ বেঁধে– এতখানি রিস্ক নিয়ে এ ব্যাপার তার কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আবুল আসফিয়ার দিকে যে ধরনে তাকাল তাতে সে দুর্বাসা হলে তিনি নিশ্চয়ই পুড়ে খাক হয়ে যেতেন– উনিই তো তার মক্কেল মেরেছেন।
তখন ভালো করে দেখলুম আবুল আসফিয়ার নবীন বেশভূষা। সেই ঝুলে পড়া আঠারো-পকেটি কোট, মাটি-ছোঁয়া, চোঙা-পানা পাতলুন, তিনি বর্জন করে পরেছেন একদম ফার্স্ট ক্লাস নেভি ব্লু স্যুট-কোট, পাতলুন ওয়েস্ট কোট সমেত সোনালি বেনারসি সিঙ্কের টাই, তদুপরি ডাইমন্ড টাই-পিন, পায়ে পেটেন্ট লেদারের মোলায়েম জুতো, তদুপরি ফন্ রঙের স্প্যাট, মাথায় উচ্চাঙ্গের ফেল্ট ব্যাট, গরম বলে বা হাতে ধরে রেখেছেন, নেবু রঙের কিড় গ্লাভস, ডান হাতে চামড়ার একটি পোর্টফোলিয়ে।