আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে শুধালুম, কী করে? কী করে? বললেন, সেকথা পরে হবে।
তার পর আপন চেয়ার ছেড়ে খানা-কামরার দিকে চলে গেলেন।
১০. পল আর পার্সিকে
১০.
পল আর পার্সিকে এখন আর বড় একটা দেখতে পাইনে। ওরা আবুল আসফিয়ার কোটের উপর ডাকটিকিটের মতো সেঁটে বসেছে–চিনে-জোকের মতো লেগে গেছে বললে কমিয়ে বলা হয়, কারণ, রক্ত শোষা শেষ হলে তবু ছিনে-জোক কামড় ছাড়ে এরা খামের উপর ডাকটিকিটের মতো, যেখানেই আবুল আসফিয়া সেখানেই তারা। মুখে এক বুলি, এক প্রশ্ন–কী করে সস্তায় কাইরে গিয়ে সেখানে থেকে সস্তাতেই ফের সঈদ বন্দরে জাহাজ ধরা যায়? আবুল আসফিয়া বলেন, হবে, হবে, সময় হলে সবই হবে।
শেষটায় জাহাজ যেদিন সুয়েজ বন্দরে পৌঁছবে তার আগের দিন তিনি রহস্যটি সমাধান করলেন। অতি সরল মীমাংসা। আমাদের মাথায় খেলেনি।
আবুল আসফিয়া বললেন, কুক কোম্পানির লোক ট্যুরিস্ট সায়েব-সুবোদের নিয়ে যাবে গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাসে করে– সুয়েজ থেকে কাইরো, এবং কাইরো থেকে সঈদ বন্দর। কাইরোতে যে রাত্রিবাস করতে হবে তার ব্যবস্থাও হবে অতিশয় খানদানি, অতএব মাগী হোটেলে। আমরা যাব থার্ডে, এবং উঠব একটা সস্তা হোটেলে। তা হলেই হল।
প্রথমটায় আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। সংবিতে ফেরামাত্র আমার মনে আরেকটি কঠিন সমস্যার উদয় হল। যদি কোনও জায়গায় আমরা ট্রেন মিস করি কিংবা অন্য কোনও দুর্ঘটনার মুখে পড়ে যাই আর শেষটায় সঈদ বন্দরে ঠিক সময়ে পৌঁছে জাহাজ না ধরতে পারি তবে যে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। বরঞ্চ চা খেতে প্লাটফর্মে নেমেছি, আর গাড়ি মালপত্র নিয়ে চলে গেল সে সমস্যারও সমাধান আছে কিন্তু জাহাজ চলে গেলে কতদিন সঈদ বন্দরে পড়ে থাকতে হবে, তার কী খরচা, নতুন জাহাজে নতুন টিকিটের জন্য কী গচ্চা এসব তো কিছুই জানিনে। কুকের লোক এসব বিপদ-আপদের জন্য জিমেদার, কিন্তু আবুল আসফিয়াকে জিম্মেদার করে তো আর আমাদের চারখানা হাত গজাবে না? তাকে তো আর বলতে পারব না, মশাই, আপনার পাল্লায় পড়ে এত টাকার গচ্চা হল- আপনি সেটা ঢালুন।
শেষের কথাটা বাদ দিয়ে আমার সমস্যাটা নিবেদন করতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় মাত্র একটি বাক্য বললেন, নো রিসক, নো গেন–সোজা বাঙলায়, খেলেন দই রমাকান্ত আর বিকারের বেলা গোবদ্দন সে হয় না। তুমি যদি দই খেতে চাও তবে বিকারটা হবে তোমারই। মাগুরমাছ ধরতে হলে গর্তে হাত দিতে হবে তোমাকেই! কিছুটা ঝুঁকি নিতে রাজি না হলে কোনও প্রকারের লাভও হয় না।
আবুল আসফিয়ার নো রিস্ক নো গেন এই চারটি কথা– চাট্টিখানি কথা নয়– শুনে পল দুশ্চিন্তাভরা গলায় বললে, তাই তো!
পার্সি মাথা নাড়িয়ে বললে, সেই তো!
আমি বললুম, ওই তো!
পল বললে, কিংবা মনে করুন কাইরোতে পথ হারিয়ে ফেললুম। আবুল আসফিয়া কি কাইরোর ভাষা জানেন? সেখানকার লোকে কী বুলি বলে তার নামই তো জানিনে!
পার্সি বললে, দেখো পল, তুমি কী জানো না তার ফিরিস্তি বানাবার এই কি প্রশস্ততম সময়? তাতে আবার সময়ও তো লাগবে বিস্তর।
আমি পার্সিকে ফাঁকা ধমক দিয়ে বললুম, আবার! পলকে বললুম আরবি। কিন্তু কিছু কিছু লোক নিশ্চয়ই ইংরেজি-ফরাসি জানে। রাস্তা ফের খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।
পল বললে, যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ততক্ষণে হয়তো জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গিয়েছে।
আরও অনেক অসুবিধার কথা উঠল। তবে সোজা কথা এই দাঁড়াল, একটি দেশের ভাষার এক বর্ণ না জেনে, এতখানি কম সময় হাতে নিয়ে সে দেশে ঘোরাঘুরি করা কি সমীচীন? এতই যদি সোজা এবং সস্তা হবে তবে এতগুলো লোক কুকের ন্যাজ ধরে যাচ্ছে কেন? একা একা কিংবা আপন আপন দল পাকিয়ে গেলেই তো পারত। তাই দেখা যাচ্ছে আবুল আসফিয়ার নো রিসক, নো গেন প্রবাদে অন্তত এক্ষেত্রে রিসক ন সিকে গেন মেরে কেটে চোদ্দ পয়সা। রবিঠাকুর বলেছেন,
আমার মতে জগন্টাতে ভালোটারই প্রাধান্য
মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন।
যদি আমাদের রিসক সাতান্ন আর গেন তিন-চল্লিশ হত তা হলেও আমরা কানাইলালের মতো সোল্লাসে ইয়াল্লা বলে ঝুলে পড়তুম যাচ্ছি তো মুসলমান দেশে।
তখন স্থির হল, আবুল আসফিয়াকে পাকড়াও করে আরেক দফা সবিস্তার সওয়াল-জবাব না করে কোনওকিছু পাকাপাকি মনস্থির করা যাবে না।
ধুয়া-ভুয়া করে করে, বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর আমরা আবুল আসফিয়াকে পেলুম উপরের ডেকের এক কোণে, আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাইছেন। আমাদের দেখে, আমাদের কিছু বলার পূর্বেই বেশ একটু চড়া গলায় বললেন, আমি কোনও কথাই শুনতে চাইনে। আমি কোনও উত্তর দিতে পারব না। আমি কাইরো যাব। তোমরা আসতে চাও ভালো, না আসতে চাও আরও ভালো।
সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও একটা শব্দ শুনতে পেলুম–শব্দটা ফারসি, বুজ-দিল–অর্থাৎ বকরির কলিজা, অর্থাৎ ভীতুরা সব।
এই শান্ত প্রকৃতি সদাশিব লোকটির কাছ থেকে আমরা এ আচরণ প্রত্যাশা করিনি। এ যেন সেনাপতির আদেশ, আমি তাহলে একাকী শত্রুসৈন্য আক্রমণ করব, তোমরা আসো আর না-ই আসো। ত্রিমূর্তি লড়াহত সারমেয়বৎ নিম্নপুচ্ছ হয়ে স্ব-স্ব আসনে ফিরে এলুম। কারও মুখে কথা নেই। নিঃশব্দে আহারাদি করে যে যার কেবিনে শুয়ে পড়লুম।
সিংহের ন্যাজে মোচড় দিতে নাই; কথাটি অতি খাঁটি, কিন্তু আবুল আসফিয়া সিংহ না মর্কট সেটা তো এখনও কিছু বোঝা গেল না। তার আচরণ তেজীয়ান না লেজীয়ানের লক্ষণ তার তো কোনও হদিস পাওয়া গেল না।