জাহাজেও তাই। একদল লোক দিবারাত্রি তাস খেলে। সকালবেলাকার আণ্ডা-রুটি খেয়ে সেই যে তারা তাসের সায়রে ডুব দেয়, তার পর রাত বারোটা-একটা-দুটো অবধি তাদের টিকি টেনেও সে সায়র থেকে ভোলা যায় না। লাঞ্চ সাপার খেতে যা দু একবার তাস ছাড়তে হয়, ব্যস্– ওই। তখন হয় বলে কী গরম, নয় ওই তাসের জেরই কানার টেবিলে টানে। চার ইস্কাপন না ডেকে তিন বে-তরুপ বললে ভালো হত, পুনরপি ডবল না বলে সে কী আহাম্মুকিই না করেছে?
জাহাজের বেসরকারি ইতিহাস বলে, একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা তাস খেলেছে এমন ঘটনাও নাকি বিরল নয়। এরা গরমে কাতর হয় না, শীতেও বেকাবু হয় না। ভগবান এদের প্রতি সদয়।
দাবাখেলার চর্চা পৃথিবীতে ক্রমেই কমে আসছে। আসলে কিন্তু দাবাড়ুই এ ব্যাপারে দুনিয়ার আর সবাইকে মাত করতে পারে। দাবাখেলায় যে মানুষ কী রকম বাহ্যজ্ঞানশূন্য হতে পারে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পরশুরাম লিখেছেন এক দাবাড়কে যখন চাকর এসে বললে, চা দেব কী করে?- দুধ ছিঁড়ে গেছে তখন দাবাড়ু খেলার নেশায় বললে, কী জ্বালা, সেলাই করে নে না!
আরেক দল শুধু বই পড়ে। তবে বেশিরভাগই দেখেছি, ডিটেকটিভ উপন্যাস। ভালো বই দিবা-রাত্র পড়ছে এরকম ঘটনা খুব কমই দেখেছি।
আরেক দল মারে আড্ডা। সঙ্গে সঙ্গে গুনগুন করে আড্ডার যেটা প্রধান মেনু পরনিন্দা, পরচর্চা। সেগুলো বলতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু পাছে কোনও পাঠক ফস করে শুধায়, এগুলো আপনি জানলেন কী করে, যদি নিজে পরনিন্দা না করে থাকেন? তাই আর বললুম না।
আরও নানা গুষ্ঠী নানা সম্প্রদায় আছে, কিন্তু আবুল আসফিয়া কোনও গোত্রেই পড়েন না। তিনি আড্ডাবাজদের সঙ্গে বসেন বটে, কিন্তু আড্ডা মারেন না– খেয়ানৌকার মাঝি যেরকম নদী পেরোয়, কিন্তু ওপারে নাবে না। একথা পূর্বেই বলেছি, কিন্তু আজ হঠাৎ তাকে দেখি অন্য রূপে। খুলে কই।
পার্সি সেরে উঠে আবার জাহাজময় লম্ফঝম্ফ লাগিয়েছে। যেখানেই যাই সেখানেই পার্সি। মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে, তবে কি পার্সির জন আষ্টেক যমজ ভাই আছে নাকি? একই লোক সাত জায়গায় একসঙ্গে থাকবে কী করে?
সে-ই খবরটা আনলে।
কী খবর?
জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছানোর পর ঢুকবে সুয়েজ খালে। খালটি একশো মাইল লম্বা। দু-পাড়ে মরুভূমির বালু বলে জাহাজকে এগুতে হয় ঘন্টায় পাঁচ মাইল বেগে। তা হলে লাগল প্রায় কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা। খালের এ মুখে সুয়েজ বন্দর, ও মুখে সঈদ বন্দর। আমরা যদি সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেন ধরে কাইরো চলে যাই এবং পিরামিড দেখে সেখান থেকে ট্রেন ধরে সঈদ বন্দর পৌঁছই, তবে আমাদের আপন জাহাজই আবার ধরতে পারব। যদিও আমরা মোটামুটি একটা ত্রিভুজের দুই বাহু পরিভ্রমণ করব– আর সুয়েজ খাল মাত্র এক বাহু তবু রেলগাড়ি তাড়াতাড়ি যাবে বলে আমরা কাইরোতে এটা-ওটা দেখবার জন্য ঘণ্টা দশেক সময় পাব।
কিন্তু যদি সুয়েজ বন্দরে নেমে সময়মতো ট্রেন না পাই, কিংবা যদি কাইরো থেকে সময়মতো সঈদ বন্দরের ট্রেন না পাই আর সেখানে জাহাজ না ধরতে পারি, তখন কী হবে উপায়?
পার্সি অসহিষ্ণু হয়ে বললে, সে তো কুক কোম্পানির জিম্মাদারি। তারাই তো এ টুর—না এক্সকাশন, কী বলব? বন্দোবস্ত করেছে। প্রতি জাহাজের জন্যই করে। বিস্তর লোক যায়। চলুন না, নোটিশবোর্ডে দেখিয়ে দিচ্ছি– কুকের বিজ্ঞাপন।
ত্রিমূর্তি সেখানে গিয়ে সাতিশয় মনোযোগ সহকারে প্রস্তাবটি অধ্যয়ন করলুম।
কিন্তু প্রস্তাবটির শেষ ছত্র পড়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম নয়, দড়াম করে ফেটে গেল। এই এক্সকার্শন-বন-ভোজ কিংবা শহর-ভোজ, যাই বলে, যাচ্ছি তো কাইরো শহরে– যারা করতে চান তাদের প্রত্যেককে দিতে হবে সাত পৌন্ড অর্থাৎ প্রায় একশো টাকা। পল বললে, হরি, হরি (অবশ্য ইংরেজিতে গুড হেভেন্স, মাই গুডনেস এইজাতীয় কিছু একটা) এত টাকা যদি আমার থাকবেই তবে কি আমি এই জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসে যেতুম না?
আমি বেদনাতুর হওয়ার ভান করে বললুম, কেন ভাই, আমরা কি এতই খারাপ লোক যে আমাদের এড়াবার জন্য তুমি ফার্স্ট ক্লাসে যেতে চাও?
পল তো লজ্জায় লাল হয়ে তোতলাতে আরম্ভ করলে।
আর পার্সি? সে তো হনুমানের মতো চক্রাকারে নৃত্য করে বলতে লাগল, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে। কর মস্করা স্যারের সঙ্গে! বোঝ ঠ্যালা!
আমি বললুম, ব্যস্, ব্যস্! হয়েছে। হয়েছে। কিন্তু পার্সি, একশো টাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমাকেই তো টালমাটাল হয়ে টাকাটা টানতে হবে।
পার্সিকে দমানো শক্ত। বললে, অপরাধ নেবেন না, স্যর, কিন্তু আমিই-বা কোন হেনরি ফোর্ড কিংবা মিডাস রোটশিট? কিন্তু আমি মনস্থির করেছি, আমার জেবের শেষ পেনি দিয়ে আমি পিরামিড দেখবই দেখব। চীনা দেওয়াল দেখার পর পিরামিড দেখব না আমি? মুখ। দেখাব তা হলে কী করে? তার চেয়েও খারাপ, আয়নাতে নিজেরই মুখ দেখব কী করে?
অনেক আলোচনা, বিস্তর গবেষণা করা হল। শেষটায় স্থির হল, পিরামিড-দর্শন আমাদের কপালে নেই। গালে হাত দিয়ে যখন ত্রিমূর্তি আপন মনে সেই শোক ভুলবার চেষ্টা করছি এমন সময় আবুল আসফিয়া মুখ খুললেন।
তার সনাতন অভ্যাস অনুযায়ী তিনি আমাদের আলোচনা শুনে যাচ্ছিলেন। ভালো-মন্দ কিছুই বলেননি। আমরা যখন স্থির করলুম, আমরা ট্রিপটা নেব না তখন তিনি বললেন, এর চেয়ে সস্তাতেও হয়।