আমি একবার একজন খালাসিকে সাঁতরে এসে জাহাজে উঠতে দেখেছি। তখন তার আর সব খালাসি ভাইয়ারা যা গালিগালাজ দিয়েছিল তা শুনে আমি কানে আঙুল দিয়ে বাপ বাপ করে সরে পড়েছিলুম। ইংরাজিতে বলে, হি ক্যান সুএ্যার লাইক এ সেলার অর্থাৎ খালাসিরা কটুবাক্য বলাতে এ দুনিয়ার সবচাইতে ওস্তাদ। ওরা যে ভাষা ব্যবহার করে সেটা বর্জন করতে পারলে দেশ-বিদেশে তুমি মিষ্টভাষীরূপে খ্যাতি অর্জন করতে পারবে।
তোমার যদি– ফারসি পড়নে-ওলা ক্লাসফ্রেন্ড থাকে তবে তাকে জিগ্যেস কর, ইস্কর-ই-রুমিরা পুরসিদ–অর্থাৎ আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে জিগ্যেস করা হয়েছিল— দিয়ে যে গল্প আরম্ভ, তার গোটাটা কী? গল্পটা হচ্ছে, সিকন্দরশাহকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, তা আপনি কার কাছ থেকে শিখেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, বে-আদবদের কাছ থেকে। সে কী প্রকারে সম্ভব? তারা যা করে আমি তাই বর্জন করেছি।
খুব যে একটা দারুণ চালাক গল্প হল তা বলছিনে। তবে জাহাজের খালাসিদের বিশেষ করে ইংরেজ খালাসিদের ভাষাটা বর্জন করলেই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
জাহাজের সিঁড়ি ওঠার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখবে দু-একটা লোক এক লাফে তিন ধাপ ডিঙোতে ডিঙোতে জাহাজে উঠছে। এরা কি একটু সময় করে আগেভাগে আসতে পারে না? আসলে তা নয়। কোনও বেচারিকে কাস্টমস হাউস (যারা আমদানি-রপ্তানি মালের ওপর কড়া নজর রেখে মাশুল তোলে) আটকে রেখেছিল, শেষ মুহূর্তে খালাস পেয়েছে, কেউ-বা আধঘণ্টা আগে খবর পেয়েছে কোনও যাত্রী এ জাহাজে যাবে না বলে খালি বার্থটা সে পেয়ে গিয়েছে কিংবা কেউ শহর দেখতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কোনও গতিকে এইমাত্র বন্দর আর জাহাজ খুঁজে পেয়েছে।
বদর বদর বলে জাহাজ বন্দরের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল।
অজানা সমুদ্রের বুকে ভেসে যাওয়ার ঔৎসুক্য একদিকে আছে, আবার ডাঙা থেকে ছুটি নেবার সময় মানুষের মন সবসময়ই একটা অব্যক্ত বেদনায় ভরে ওঠে। অপার সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সীমার শেষের দিথলয়ের দিকে তাকিয়ে মুক্ত মনের যত অগাধ আনন্দই পাও না কেন, ঝঞ্ঝাবাত্যার সঙ্গে দুর্বার সংগ্রাম করে করে ক্ষণে-বাচা ক্ষণে-মরার অতুলনীয় যত অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় কর না কেন, মাটির কোলে ফিরে আসার মতো মধুময় অভিজ্ঞতা অন্য কিছুতেই পাবে না। তাই ভ্রমণকারীদের গুরু, গুরুদেব বহু নদ-নদী সাগর-সমুদ্র উত্তীর্ণ হওয়ার পর বলেছেন–
ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।
জাহাজ ছাড়তে ছাড়তে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
আমি জাহাজের পিছন দিকে রেলিঙের উপর ভর করে তাকিয়ে রইলুম আলোকমালায় সুসজ্জিত মহানগরীর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দরের দিকে। সেখানে রাস্তায় রাস্তায়, সমুদ্রের জাহাজে জাহাজে আর জেলেদের ডিঙিতে ডিঙিতে কোথাও-বা সারে সারে প্রদীপশ্রেণি আর কোথাও-বা এখানে একটা ওখানে দুটো, সেখানে একঝাক যেন মাটির সাত-ভাই-চম্পা।
আমরা দেয়ালি জ্বালি বছরের মাত্র এক শুভদিনে। ওখানে সম্বৎসর দেয়ালির উৎসব। এদের প্রতিদিনের প্রতি গোধূলিতে শুভ লগ্ন। আর এদের এ উৎসব আমাদের চেয়ে কত সর্বজনীন! এতে সাড়া দেয় সর্ব ধর্ম সর্ব সম্প্রদায়ের নরনারী… হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টান!
আমি জানি, বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, কোনও কোনও ছোট্ট পাখির রঙ যে সবুজ তার কারণ সে যেন গাছের পাতার সঙ্গে নিজের রঙ মিলিয়ে দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, যাতে করে শিকারে পাখি তাকে দেখতে পেয়ে ছোঁ মেরে না নিয়ে যেতে পারে! তাই নাকি আমের রঙও কাঁচা বয়সে থাকে সবুজ– যাতে পাখি না দেখতে পায়, এবং পেকে গেলে হয়ে যায় লাল, যাতে করে পাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে–যাতে সে যেন ঠুকরে ঠুকরে তাকে গাছ থেকে আলাদা করে দেয়, নিচে পড়ে তার আঁটি যেন নতুন গাছ জন্মাতে পারে।
বৈজ্ঞানিকদের ব্যাখ্যা ভুল, আমি বলি কী করে? বিজ্ঞানের আমি জানি কতটুকু, বুঝি কতখানি? কিন্তু আমার সরল সৌন্দর্য-তিয়াষী মন এসব জেনে-শুনেও বলে, না, পাখি যে সবুজ, সে শুধু তার নিজের সৌন্দর্য আর আমার চোখের আনন্দ বাড়াবার জন্যে। এর ভিতর ছোট হোক, বড় হোক, কোনও স্বার্থ লুকনো নেই। সৌন্দর্য শুধু সুন্দর হওয়ার জন্যই।
ঠিক তেমনি আমি জানি, পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে প্রতি গোধূলিতে যে আলোর বান জেগে ওঠে, তার মধ্যে স্বার্থ লুকনো আছে। ওই আলো দিয়ে মানুষ একে অন্যকে দেখতে পায়, বাপ ওই আলোতে বাড়ি ফেরে, মা তার শিশুকে খুঁজে পায়, সবাই আপন আপন গৃহস্থালির কাজ করে; কিন্তু তবু যখনই আমি দূরের থেকে এই আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, তখনই মনে হয় এগুলো জ্বালানো হয়েছে শুধুমাত্র দেয়ালির উৎসবকে সফল করার জন্য। তার ভিতর যেন আর কোনও স্বার্থ নেই।
অকূল সমুদ্রে পথহারা নাবিক তারার আলোয় ফের পথ খুঁজে পায়। সেই স্বার্থের সত্য উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন–
তুমি কত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
কি উৎসবের লগনে।
বন্দরের আলোর দিকে তাকিয়ে যদি আমিও ভগবানের উদ্দেশে বলি–
মোরা কত আলো জ্বালিয়েছি ওই চরণে
কি আরতির গগনে।
তবে কি বড্ড বেশি ভুল বলা হবে?
অনেক দূরে চলে এসেছি। পাড়ের আলো ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। তবু এখনও দেখতে পাই হুশ করে একখানা জেলেডিঙি আমাদের পাশ দিয়ে উল্টোদিকে চলে গেল। আসলে কিন্তু সে হুশ করে চলে যায়নি। সে ছিল দাঁড়িয়েই, কারণ তার গলুই সমুদ্রের দিকে মুখ করে। আছে, আমরা তাকে পেরিয়ে গেলুম মাত্র।