পার্সি কিন্তু তৈরি ছেলে। সেই ছটফটানির ভিতর থেকে কাতরাতে কাতরাতে বলল, কিন্তু এখন যদি কোনও ডুবন্ত দ্বীপের মাটিতে ধাক্কা লেগে জাহাজখানা চৌচির হয়ে যায় তখনও মাটির গুণগান করবেন নাকি?
আমি বললুম, ওই য যা! এতখানি ভেবে তো আর কথাটা বলিনি।
পল তার খাটে বসে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। আস্তে আস্তে বললে, জাহাজ যদি মাটিতে লেগে চৌচির হয়ে যায় তবে তো সেটা মাটির দোষ নয়। জাহাজ জোরের সঙ্গে ধাক্কা দেয় বলেই তো খান খান হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চললে মাটির বাধা পেয়ে জাহাজ বড়জোর দাঁড়িয়ে যাবে। ভাঙবে কেন? মাকে পর্যন্ত জোরে ধাক্কা দিলে চড় খেতে হয়, আর মাটি দেবে না?
আমি উল্লসিত হয়ে বললুম, সাধু সাধু! তুলনাটি চমৎকার! তবে কি না আমার দুঃখ, বাঙলা ভাষায় এ নিয়ে যে শব্দদুটো আছে তার pun তোমরা বুঝবে না। মা হচ্ছেন মাদার আর মাটি হচ্ছেন দি মাদার কিংবা আর্থ।
পল বললে, বিলক্ষণ বুঝেছি, Good Earth!
পার্সি বিরক্ত হয়ে বললে, পলের তুলনাটা নিশ্চয়ই চোরাই মাল।
আমি বললুম, সাধুর টাকাতে দু সের দুধ, চোরের টাকাতেও দু সের দুধ। টাকার দাম একই। তুলনাটা ভালো। তা সে পলের আপন মালই হোক আর চোরাই মালই হোক। তা সেকথা থাক। তুমি কিন্তু সি সিকনেসে কাতর হয়ে ভয় পেয়ো না। এ ব্যামোতে কেউ কখনও মারা যায়নি।
পার্সি চিঁ চিঁ করে বললে, শেষ ভরসাটাও কেড়ে নিলেন, স্যরআমি তো ভরসা করেছিলুম আর বেশিক্ষণ ভুগতে হবে না, মরে গিয়ে নিষ্কৃতি পাব।
পল বললে, আগাছা সহজে মরে না।
আমি বললুম, থাক, থাক। চলো পল, উপরে যাই। আমরা তিনজন মিলে সি সিনেসকে বড্ড বেশি লাই দিচ্ছি।
পল বেরুতে বেরুতে বললে, হক কথা। পার্সির সঙ্গে একা পড়লে যে কোনও ব্যামো বাপ বাপ করে পালাবার পথ পাবে না।
উপরে এসে দেখি, আবুল আসফিয়া কোথা থেকে এক জোরদার দুরবিন যোগাড় করে কী যেন দেখবার চেষ্টা করছেন। এসব জাহাজ কখনও পাড়ের গা ঘেঁষে চলে না। তাই জোরালো দুরবিন দিয়ে বিশেষ কিছু দেখা যায় না। পল আমাকে শুধালে, কী দেখছেন উনি?
আমি বললুম, আবুল আসফিয়া মুসলমান এবং মনে হচ্ছে ধর্মে তাঁর অনুরাগও আছে। লাল দরিয়ার এক পারে সোমালি ভূমি, হাবসি মুলুক এবং মিশর, অন্য পারে আরব দেশ। মহাপুরুষ মুহম্মদ আরবদেশে জন্মেছিলেন, ওই দেশে ইসলাম প্রচার করেন। মক্কা মদীনা, সবই তো ওইখানে।
পল বললে, ইংরেজিতে যখনই কোনও জিনিসের কেন্দ্রভূমির উল্লেখ করতে হয় তখন বলা হয়, যেমন ধরুন সঙ্গীতের বেলায়, ভিয়েনা ইজ দি মেক্কা অব মিউজিক– এ তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু বিশেষ করে মক্কা বলা হয় কেন? মক্কা তো আর তেমন কিছু বড় শহর নয়।
আমি বললুম, পৃথিবীতে গোটা তিনেক বিশ্বধর্ম আছে, অর্থাৎ এ ধর্মগুলো যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে সেখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি–দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন মনে কর বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম। কিন্তু পৃথিবীর বহু বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান কোনও বিশেষ পুণ্যদিবসে এক বিশেষ জায়গায় একত্র হয় না– মুসলমানরা যেরকম হজের দিনে মক্কায় একত্র হয়। কোথায় মরক্কো, কোথায় সাইবেরিয়া আর কোথায় চীন পৃথিবীর যেসব দেশে মুসলমান আছে সেসব দেশের লোককে সেদিন তুমি মক্কায় পাবে। শুনেছি, সেদিন নাকি মক্কার রাস্তায় দুনিয়ার প্রায় সব ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়।
তাতে করে লাভ?
আমি বললুম, লাভ মক্কাবাসীদের নিশ্চয়ই হয়। তীর্থযাত্রীরা যে পয়সা খরচ করে তার সবই তো ওরা পায়। কিন্তু আসলে সে উদ্দেশ্য নিয়ে একথা সৃষ্টি হয়নি। মুহম্মদ সাহেবের ইচ্ছা ছিল যে, পৃথিবীর সব দেশের মুসলমানকে যদি একত্র করা যায় তবে তাদের ভিতর ঐক্য এবং ভ্রাতৃভাব বাড়বে। আমরা যখন বাড়িতে উপাসনা না করে গির্জায় কিংবা মসজিদে যাই তখন তারও তো অন্যতম উদ্দেশ্য আপন ধর্মের লোকের সঙ্গে এক হওয়া। মুহম্মদ সাহেব বোধহয় এই জিনিসটাই বড় করে, সমস্ত পৃথিবী নিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
পল অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, আমরা তো বড়দিনের পরবে প্রভু যিশুর জন্মস্থল বেথলেহেমে জড় হইনে। হলে কি ভালো হত না? তা হলে তো খ্রিস্টানদের ভিতরও ঐক্য সখ্য বাড়ত।
আমি আরও বেশি ভেবে বললুম, তা হলে বোধহয় রোমে পোপের প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হত।
কিন্তু থাক এসব কথা। আমার কোনও ক্যাথলিক পাঠক কিংবা পাঠিকা যেন মনে না করেন যে, আমি পোপকে শ্রদ্ধা করিনি। পৃথিবীর শত শত লক্ষ লক্ষ লোক যাকে সম্মানের চোখে দেখে তাকে অশ্রদ্ধা করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই শত শত লক্ষ লক্ষ লোককে অশ্রদ্ধা করা হয়। অতটা বেয়াদব আমি নই। বিশেষত আমি ভারতীয়। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, সব ধর্মকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।
.
০৯.
ঝড় থেমেছে। সমুদ্র শান্ত। ঝড়ের পর বাতাস বয় না বলে অসহ্য গরম আর গুমোট। এ যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাই কী প্রকারে।
নিষ্কৃতির জন্য মানুষ ডাঙায় যা করে, জলে অর্থাৎ জাহাজেও তা-ই। একদল লোক বুদ্ধিমান। কাজে কিংবা অকাজে এমনি ডুব মারে যে, গরমের অত্যাচার সম্বন্ধে অনেকখানি অচেতন হয়ে যায়। বোকার দল শুধু ছটফট করে। ক্ষণে এটা করে, ক্ষণে ওটা নাড়ে, ক্ষণে ঘুমাবার চেষ্টা করে, ক্ষণে জেগে থাকতে গিয়ে আরও বেশি কষ্ট পায়।