এইখানেই মহামানব এবং হীনপ্রাণে পার্থক্য! মহাপুরুষরা দৈন্য দেখে কখনও অভ্যস্ত হন না। কখনও বলেন না, এ তো সর্বত্রই হচ্ছে, অহরহ হচ্ছে ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। দৈন্য তাদের সবসময়ই গভীর পীড়া দেয় যদিও আমরা অনেক সময় তাদের চেহারা দেখে সেটা বুঝতে পারিনে। তার পর একদিন তারা সুযোগ পান, যে সুযোগের প্রতীক্ষায় তারা বছরের পর বছর প্রহর গুনছিলেন, কিংবা যে সুযোগ তারা ক্ষণে ক্ষণে দিনে দিনে আপন হাতে গড়ে তুলছিলেন, এবং এরই বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
অখ্যাত অজ্ঞাত রহি দীর্ঘকাল হে রাজবৈরাগী, গিরিদরী-তলে
বর্ষার নিঝর যথা শৈল বিদারিয়া উঠে জাগি পরিপূর্ণ বলে
সেই মত বাহিরিলে; বিশ্বলোক ভাবিল বিস্ময়ে যাহার পতাকা
অম্বর আচ্ছন্ন করে এত কাল এত ক্ষুদ্র হয়ে কোথা ছিল ঢাকা।
তাই যখন হঠাৎ একদিন এক অরবিন্দ ঘোষ, এক চিত্তরঞ্জন দাশ এসে আমাদের মাঝখানে দেখা দেন তখন আমাদের আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না। আজন্ম, আশৈশব, অনটনমুক্ত বিলাসে জীবনযাপন করে হঠাৎ একদিন তারা সবকিছু বিসর্জন করে গিয়ে দাঁড়ান গরিব দুঃখী, আতুর অভাজনের মাঝখানে। যে দৈন্য দেখে ভিতরে ভিতরে গভীর বেদনা পেতেন, সেই দৈন্য ঘুচাতে গিয়ে তারা তখন পান গভীরতর বেদনা। কিন্তু সত্যের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই হবে।
–তাই উঠে বাজি
জয়শঙ্খ তার? তোমার দক্ষিণ করে।
তাই কি দিলেন আজি কঠোর আদরে
দুঃখের দারুণ দীপ আলোক যাহার
জ্বলিয়াছে বিদ্ধ করি দেশের আঁধার
ধ্রুব তারকার মতো। জয় তব জয়।
কিন্তু এতসব কথা তোমাদের শোনাচ্ছি কেন? তার কারণ গত রাত্রে জাহাজে বসে আফ্রিকা মহাদেশ এবং বিশেষ করে যে সোমালি দেশের ভিতর জিবুটি বন্দর অবস্থিত তারই কথা ভাবছিলুম বলে। এবং সেই সোমালিদের দুঃখ-দৈন্য ঘোচাবার জন্য যে একটি লোক বিদেশি শক্রদের সঙ্গে প্রাণ দিয়ে লড়েছিল তার কথা বার বার মনে পড়ছিল বলে।
ইয়োরোপীয় বর্বরতার চূড়ান্ত বিকাশ দেখতে হলে পড়তে হয় আফ্রিকার ইতিহাস ইংরেজশাসিত ভারতের ইতিহাস তার তুলনায় নগণ্য।
পর্তুগিজ, ইংরেজ, জর্মন, ফরাসি, বেলজিয়াম– কত বলব। ইয়োরোপীয় বহু জাত, কমজাত, বজ্জাত এই আফ্রিকায় একদিন এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের বর্বর পাশবিক ক্ষুধা নিয়ে, শকুনের পাল যেরকম মরা গরুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভুল বললুম, শকুনিদের ওপর অবিচার করা হল, কারণ তারা তো জ্যান্ত পশুর উপর কখনও ঝাঁপ দেয় না। এই ইয়োরোপীয়রা এসে ঘেঁকে ধরল সোমালি, নিগ্রো, বান্টু, হটেনটটদের। তাদের হাতে-পায়ে বেঁধে মুরগিলাদাই কঁকার মতো জাহাজভর্তি করে নিয়ে গেল আমেরিকায়। কত লক্ষ নিগ্রো দাস যে তখন অসহ্য যন্ত্রণায় মারা গেল তার নিদারুণ করুণ বর্ণনা পাবে আঙ্কল টম ক্যাবিন পুস্তকে বইখানা পড়ে দেখ। ইংরেজি ভালো বুঝতে না পারলে বাংলা অনুবাদ টম্ কাকার কুটির পড়লেই হবে– আমি ছেলেবেলায় বাংলাতেই পড়েছিলুম।
আর আফ্রিকার ভিতরে যা করল তার ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। বিখ্যাত ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদ কঙ্গো সম্বন্ধে একখানা বই লিখে এমনই বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, তার মতো দুঃসাহসী না হলে ওই সম্বন্ধে কেউ আর উচ্চবাচ্য করতে সাহস পায় না। আর লিখলেই-বা কী, প্রকাশক পাবে না। প্রকাশক পেলেই-বা কী? কাগজে কাগজে বেরুবে তার বিরুদ্ধে রূঢ় মন্তব্য, অশ্লীল সমালোচনা। তখন আর কোনও পুস্তকবিক্রেতা তোমার বই তার দোকানে রাখবে না। তবু জেনে রাখা ভালো, এমন মহাজনও আছেন যারা এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বই লেখেন, ছাপান, প্রকাশ করেন এবং লোকে সেসব পড়ে বলে দেশে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি হয়।
সোমালি দেশের ওপর রাজত্ব করতে এসেছিল বিস্তর জাত : তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত টিকে রইল ফরাসি, ইংরেজ ও ইতালীয়।
ব্রিটিশ-সোমালি দেশে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। নিরস্ত্র কিংবা ভাঙাচোরা বন্দুক আর তীর-ধনুক সজ্জিত সোমালিরা তার চতুর্দিকে এসে জড় হল অসীম সাহস নিয়ে–ইয়োরোপীয় কামান মেশিনগানের বিপক্ষে। এদিকে ইতালীয় এবং ব্রিটিশে সোমালি দেশের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মারামারি, ওদিকে কিন্তু দুই দলই এক হয়ে গেলেন মোল্লা মুহম্মদের স্বাধীনতা প্রচেষ্টাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য।
দুই পক্ষেরই বিস্তর হার-জিত হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোল্লাই ইয়োরোপীয়দের খেদিয়ে খেদিয়ে লাল দরিয়ার পার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেন। ইংরেজ তখন সোমালিদের ওপর রাজত্ব করার আশা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রপারে দুর্গ বানিয়ে তারই ভিতর বসে রইল লাল দরিয়ার বন্দরগুলো বাঁচিয়ে রাখবার জন্য।
সারা সোমালি দেশে জয়ধ্বনি জেগে উঠল– সোমালি স্বাধীন! তখন ইংরেজ তাকে নাম দিল, ম্যাড মোল্লা অর্থাৎ পাগলা মোল্লা, আমাদের গাঁধীকে যেরকম একদিন নাম দিয়েছেন, নেকেড ফকির অর্থাৎ উলঙ্গ ফকির। হেরে যাওয়ার পর মুখ ভ্যাংচানো ছাড়া করবার কী থাকে, বল?
কিন্তু হায়, খুব বেশি বৎসর গেল না। ১৯১৪-১৮-এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইয়োরোপীয়রা অ্যারোপ্লেন থেকে বোমা মেরে মানুষকে কাবু করার কৌশল শিখে গিয়েছে। তাই দিয়ে যখন আবার তারা হানা দিলে তখন মোল্লাকে সে সময়কার মতো পরাজয় স্বীকার করে আশ্রয় গ্রহণ করতে হল ভিন্ দেশে।