নাহ! স্বপ্ন। বাঁচলুম। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছে। চোখ মেলতে দেখি, কেবিনের সব-কটা আলো জ্বলছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে পল আর পার্সি। পল দাঁড়িয়ে আছে সত্যি কিন্তু পার্সিটা জুলু না হটেনটট কী যেন এক বিকট আফ্রিকান নৃত্য জুড়েছে–আফ্রিকানই হবে, কারণ ওই মহাদেশেরই গা ঘেঁষে তো এখন আমরা যাচ্ছি।
তা আফ্রিকার হটেনটটীয় মার্তণ্ড-তাত্ব নৃত্যই হোক আর ইয়োরোপীয় মাসুকা কিংবা ল্যামবেথ-উয়োক্-ই হোক আমি অবশ্য এ দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্যই দেখতে পাইনে, সঙ্গীতে তো আদৌ না– পার্সি এ সময়ে আমার কেবিনে এসে বি-নোটিশে নাচ জুড়বে কেন?
নাহ, নাচ নয়। বেচারি উত্তেজনায় তিড়িংবিড়িং করছে আর যে কাতর রোদন জানাচ্ছে সেটার সামারি করলে দাঁড়ায়;
হায়, হায়, সবকিছু সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেল, স্যর! আপনি এখনও অকাতরে নাক ডাকাচ্ছেন। আমার জীবন বিফল হল, পলের জীবনও বৃথায় গেল। জাহাজ রাতারাতি ডুব সাঁতার কেটে জিবুটি বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে। সবাই জামাকাপড় পরে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে পারে নামবার জন্য তৈরি, আর আপনি– হায়, হায়!
(এই বইখানার যদি ফিল হয় তবে এ স্থলে অশ্রুবর্ষণ ও ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস)
আমি চোখ বন্ধ করলুম দেখে পার্সি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল।
আমি শান্ত কণ্ঠে শুধালুম, জাহাজ যদি জিবুটি পৌঁছে গিয়ে থাকে তবে এখনও এঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেন?
পার্সি অসহিষ্ণুতা চাপাবার চেষ্টা করে বললে, এঞ্জিন বন্ধ করা, না করা তো এক মিনিটের ব্যাপার।
আমি বললুম, নৌভ্রমণে আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলে, এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পরও জাহাজ থেকে নামতে নামতে ঘণ্টা দুয়েক কেটে যায়।
পল, এই প্রথম মুখ খুললে; বললে, বন্দর যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
আমি বললুম, দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্খর চুড়োটা স্পষ্ট দেখা যায়, তাই বলে কি সেখানে দশ মিনিটে পৌঁছানো যায়?
তার পর বললুম, কিন্তু এসব কুতর্ক। আমি হাতে-নাতে আমার বক্তব্য প্রমাণ করে দিচ্ছি।
তার পর অতি ধীরেসুস্থে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলুম। পল আমার কথা শুনে অনেকখানি আশ্বস্ত কিন্তু পার্সি তখনও ব্যস্তসমস্ত। আমাকে তাড়া লাগাতে গিয়ে দাড়ি কামানো বুরুশটা এগিয়ে দিতে গিয়ে তুলে ধরে দাঁতের বুরুশ ওইটে দিয়ে গাল ঘষলে মুখপোড়া হনুমান হতে কতক্ষণ টাই ভেবে সামনে ধরে ড্রেসিংগাউনের কোমর বন্ধটা। তার পর চা-রুটি, মাখন-আণ্ডাতে অপূর্ব এক ঘ্যাঁট বানিয়ে আমার সামনে ধরে চতুর্দিকে ঘুরপাক খেতে লাগল– বাড়িতে জিনিসপত্র বাঁধাই-দাই করার সময় পাপিটা যেরকম এর পা ওর পা-র ভিতর দিয়ে ঘুরপাক খায় এবং বাড়িসুদ্ধ লোককে চটিয়ে তোলে।
শেষটায় বেগতিক দেখে আমি একটু তাড়াহুড়ো করে সদলবলে ডেকে এলুম।
উপরে তখন আর সবাই অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে তাস, পাশা, গালগল্পে ফিরে গিয়েছে।
পল চোখে দুরবিন লাগিয়ে বললে, কই, স্যর বন্দর কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ধূ-ধূ করছে মরুভূমি আর টিনের বাক্সের মতো কয়েক সার একঘেয়ে বাড়ি।
আমি বললুম, এরই নাম জিবুটি বন্দর।
ওই মরুভূমিতে দেখবার মতো আছে কী?
কিচ্ছু না। তবে কী জানো, ভিদেশে পরদেশের ভিতর দিয়ে যাবার সময় অত-শত বাছবিচার করতে নেই– বিশেষত এই অল্প বয়সে। চিড়িয়াখানায় যখন ঢুকেছ, তখন বাঘ সিঙি দেবার সঙ্গে সঙ্গে খাটাশটাও দেখে নেওয়াই ভালো। আর কে জানে, কোনও মোড় ঘুরতে কোনও এক অপ্রত্যাশিত জিনিস বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে না? মোকামে পৌঁছানোর পর না হয় জমা-খরচ করা যাবে, কোনটা ভালো লাগল আর কোনটা লাগল না।
জাহাজ থেকে তড়তড় করে সিঁড়ি ভেঙে ডাঙায় নামা যায় পৃথিবীর ভালো ভালো বন্দরেই। এখানে তাই পারে যেতে হল মোটরলঞ্চ করে। জিবুটির চেয়েও নিকৃষ্ট বন্দর পৃথিবীতে হয়তো আছে কিন্তু আমার দেখার মধ্যে ওইটেই সবচেয়ে অপ্রিয়দর্শন ও বৈচিত্র্যহীন বন্দর। মরুভূমির প্রত্যন্ত ভূমিতে বন্দরটি গড়ে তোলা হয়েছে একমাত্র রাজ্য বিস্তারের লোভে। এবং এ মরুভূমিকে কোনও প্রকারের শ্যামলিমা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব জেনেই কেউ কোনওদিন কণামাত্র চেষ্টা করেননি একে একটুখানি আরামদায়ক করার।
ডাঙা থেকে সোজা চলে গিয়েছে একটা ধুলোয় ভর্তি রাস্তা বন্দরের চৌক বা ঠিক মাঝখানে। তার পর সেখান থেকে এদিকে-ওদিকে দু-চারটে রাস্তা গিয়েছে বটে কিন্তু বড় রাস্তাটা দেখার পর ওসব গলিতে ঢোকার প্রবৃত্তি সুস্থ লোকের হওয়ার কথা নয়। বড় রাস্তার দু দিকে সাদা কাম করা বাড়িগুলো এমনি মুখ গুমসো করে দাঁড়িয়ে আছে যে বাড়ির বাসিন্দারাও বোধ করি এসব বাড়িতে ঢোকার সময় দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শুকনো ঢোক গেলে কিংবা বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়ের ডান দিকটা চুলকে নেয়। ছোট গলির মুখে পঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি, মাটির তৈরি দেয়াল-ছাদের ছোট ছোট ঘর, না, ঘর নয়, গহ্বর কিংবা গুহাও বলতে পার। বৃষ্টি এদেশে এতই ছিটেফোঁটা হয় যে, ছাত গলে গিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। আর থাকলেই-বা কী, এদেশে তো আর ঘাস-পাতা গজায় না যে তাই দিয়ে চাল বানাবে?
এরই ভিতরে মানুষ থাকে, মা ছেলেকে ভালোবাসে, ভাই ভাইকে স্নেহ করে, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সবই হয়!
কিন্তু আমি এত আশ্চর্য হচ্ছি কেন? আমি কি কখনও গলির ঘিঞ্জি বস্তির ভিতর ঢুকিনি কলকাতায়। সেখানে দেখিনি কী দৈন্য, কী দুর্দশা! তবে আজ এখানে আশ্চর্য হচ্ছি কেন? বোধহয় বিদেশে এ জিনিস প্রত্যাশা করিনি বলে কিংবা দেশের দৈন্য দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি বলে বিদেশে তার অন্য রূপ দেখে চমকে উঠলুম।