হাফিজের তখন বয়স হয়েছে। তার বুড়ো হাড়-কখানা তখন আর দীর্ঘ ভ্রমণ আর দীর্ঘতর প্রবাসের জন্য দেশ ছাড়তে নারাজ। তাই কবি একটি সুন্দর কবিতা লিখে না আসতে পারার জন্য বিস্তর দুঃখ প্রকাশ করলেন।
বাঙলা দেশের সরকারি দলিল-দস্তাবেজে এ ঘটনার কোনও উল্লেখ নাই। এর ইতিহাস পাওয়া গিয়াছে ইরানের খাতাপত্র থেকে।(১)
তার পরের রাজার দৃষ্টি গেল সেই সুদূর চীনদেশের দিকে। কিন্তু চীনসম্রাটকে তো আর বাংলা দেশে নিমন্ত্রণ করা যায় না। কাজেই রাজদূতকে বহু উত্তম উপঢৌকন দিয়ে চীনের সম্রাটকে বাঙলার রাজার আনন্দ-অভিবাদন জানালেন।
চীনসম্রাট সুদূর বাঙলা দেশের রাজার সৌজন্য-দ্রতার পরিচয় পেয়ে পরম আপ্যায়িত হলেন। চীন বিত্তশালী দেশ। প্রতিদানে পাঠালেন আরও বেশি মূল্যবান উপঢৌকন। সে রাজা কিন্তু ততদিনে রাজার দেশে চলে গিয়েছেন।
বাংলার রাজা তখন ভাবলেন, চীনের সম্রাটকে আমি কী দিতে পারি যা তার নেই। রাজদূতকে মনের কথা খুলে তার উপদেশ চাইলেন। রাজদূতটি ছিলেন অতিশয় বিচক্ষণ লোক। তিনি যখন চীনে ছিলেন তখন চীনদেশের আচার-ব্যবহার বিশ্বাস-অবিশ্বাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করেছিলেন। বললেন, চীনের বহু লোকের বিশ্বাস, গাছের চেয়ে উঁচু মাথাওলা যে এক পয়মন্ত প্রাণী আছে সে যদি কখনও চীনদেশে আসে তবে সে দেশের শস্য তারই মাথার মতো উঁচু হবে।
রাজা শুধালেন, কী সে প্রাণী?
রাজদূত বললেন, জিরাফ। আফ্রিকাতে পাওয়া যায়।
রাজা বললেন, আনাও আফ্রিকা থেকে।
যেন চাট্টিখানি কথা! কোথায় বাঙলা দেশ, আর কোথায় আফ্রিকা! আজ যে এই বিরাট বিরাট কলের জাহাজ দুনিয়ার সর্বত্র আনাগোনা করে তারই একটাতে জিরাফ পোরা কী সহজ! তখনকার দিনের পালের জাহাজে আফ্রিকা থেকে বাঙলা দেশ, সেখান থেকে আবার চীন–ক মাস কিংবা ক বছর লাগবে কে জানে? ততদিন তার জন্য ওই অকূল দরিয়ায় ঘাস পাতা পাবে কোথায় দেখতে পাচ্ছি এই কলের জাহাজেই আমাদের শাকশবজি স্যালাড় খেতে দেয় অল্প– তার অন্যান্য তদারকি কি সহজ?
তখনকার দিনে আরব কারবারীরা আফ্রিকা, সোকোত্রা, সিংহল হয়ে বাঙলা দেশে ব্যবসা করতে যেত। রাজা হুকুম দিলেন, জিরাফ নিয়ে এস।
জিরাফ এল। কী খেয়ে এল, কতদিনে এল, কিছুই বলতে পারব না। রাজা জিরাফ দেখে ভারি খুশি। হুকুম দিলেন, চীনসম্রাটকে ভেট দিয়ে এস।
সেই চীন! জাহাজে করে! কতদিন লাগল কে জানে!
চীনসম্রাট সংবাদ পেয়ে যে কতখানি খুশি হয়েছিলেন তার খানিকটে কল্পনা করা যায়। তিনি হুকুম দিলেন, প্রাণীর জন্য খুব উঁচু করে আস্তাবল বানাও।
বলা তো যায় না তার মুণ্ডুটা মেঘে ঠেকবে, না চাদে ঠোক্কর লাগাবে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর জিরাফ যখন জিরিয়ে জুরিয়ে তৈরি তখন শুভদিন শুভক্ষণ দেখে, চীনসম্রাট পাত্র-অমাত্য-সভাসদসহ শোভাযাত্রা করে জিরাফ দর্শনে বেরুলেন। সঙ্গে নিলেন, বিশেষ করে, রাজচিত্রকর এবং সভাকবি।
সম্রাট জিরাফ দেখে গভীর আনন্দ লাভ করলেন। সভাসদ ধন্য ধন্য করলেন। আপামর জনসাধারণ গভীরতর সন্তোষ লাভ করল–তাদের গুরুজন বলেছিলেন যে এরকম অদ্ভুত প্রাণী পৃথিবীতে আছে, এবং সে একদিন চীনদেশে আসবে, সেটা কিছু অন্যায় বলেননি। যারা সন্দেহ করত তাদের মুণ্ডুগুলো এখন টেনে টেনে ওই জিরাফের মুণ্ডুটার মতো উঁচু করে দেওয়া উচিত।
সম্রাট চিত্রকরকে আদেশ দিলেন, এই শুভদিবস চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তুমি এই জিরাফের একটি উত্তম চিত্র অঙ্কন কর।
ছবি আঁকা হল।
সম্রাট কবিকে আদেশ করলেন, তুমি এই শুভ অনুষ্ঠানের বর্ণনা ছন্দে বেঁধে ছবিতে লিখে রাখ।
তাই করা হল।
গল্প শেষ করে বললুম, সে ছবির প্রিন্ট আমি কাগজে দেখেছি। পল শুধাল, স্যর, আপনি কী চীনা ভাষা পড়তে পারেন?
আমি বললুম, আদপেই না। আমার এক বন্ধু চীনা শিখেছে সে ভাষাতে বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ার জন্য। জান তো, আমাদের বহু শাস্ত্র এদেশে বৌদ্ধধর্ম লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু চীনা অনুবাদে এখনও বেঁচে আছে। আমার বন্ধু বৌদ্ধশাস্ত্র খুঁজতে খুঁজতে এই অদ্ভুত কাহিনীর সাক্ষাৎ পায়। তারই বাঙলা অনুবাদ করে, ছবিসুদ্ধ সেটা বাঙলা কাগজে ছাপায়। তা না হলে বাঙলা দেশের লোক কখনও এ কাহিনী জানতে পারত না, কারণ বাঙলা দেশে এ সম্বন্ধে কোনও ইতিহাস বা দলিলপত্র নেই।
পার্সি বললে, কিন্তু স্যর এটা তো ইতিহাসের মতো শোনাল না! এ যে গল্পকে ছাড়িয়ে যায়।
আমি বললুম, কেন বৎস, তোমার মাতৃভাষাতেই তো রয়েছে, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান, ফিশ–সত্য ঘটনা গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ।
এবং আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে ঘটনার বর্ণনা মানুষকে গল্পের চেয়েও বেশি সজাগ করে না তুলতে পারে, সে ঘটনার কোনও ঐতিহাসিক মূল্য নেই। কিংবা বলব, যে লোক ঘটনাটার বর্ণনা দিয়েছে সে সত্যকার ঐতিহাসিক নয়। আমার দেশে এরকম কাঠখোট্টা ঐতিহাসিকই বেশি।
.
০৬.
কলরব, চিৎকার, তারস্বরে আর্তনাদ! কী হল কী হয়েছে। তবে কী জাহাজে বোম্বেটে পড়েছে বায়স্কোপে যেরকম দেখি, বোম্বেটেরা দু হাতে দুই পিস্তল, দু পাটি দাতে ছোরা কামড়ে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজ আক্রমণ করে। তার পর হঠাৎ কানের পর্দা ফাটিয়ে এক ভয়ঙ্কর প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ- বারুদ গুদামে আগুন লেগে সেটা ফেটে গিয়েছে। তারই আগুন জাহাজের দড়াদড়ি পাল মাস্তুলে লেগে গিয়ে সমস্ত জাহাজ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।