আমি চোখ বন্ধ করে আত্মচিন্তায় মগ্ন হলেই পল-পার্সি আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে অন্য কিছু একটায় লেগে যেত। আমি তাদের সন্ধানে বেরিয়ে দেখি তারা লাউঞ্জে বসে চিঠি লিখছে। আমাকে দেখে পার্সি শুধাল, জাহাজে যে ফরাসি ডাকটিকিট পাওয়া যায় তাই দিয়ে এ চিঠি চীন দেশে যাবে তো?
আমি বললুম, নিশ্চয়। এমনকি জিবুটি বন্দরের ডাকঘরেও যদি ছাড় তবু যাবে। কারণ জিবুটি বন্দর ফরাসিদের। কিন্তু যদি পোর্টসঈদ বন্দরে ছাড় তবে সে টিকিট মিশর দেশে বাতিল বলে চিঠিখানা যাবে বেয়ারিং পোস্টে।
কিন্তু যদি পোর্ট সঈদে পৌঁছে জাহাজের লেটার বকসে ছাড়ি?
তা হলে ঠিক।
তার পর বললুম, হু। তবে বন্দরে নেমে মিশরি ডাকটিকিট লাগানই ভালো।
কেন, স্যর?
আমি বললুম, বৎস, আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, চীন দেশে তোমার একটি ছোট বোন রয়েছে। সে নিশ্চয়ই ডাকটিকিট জমায়। তুমি যদি বন্দরে বন্দরে ফরাসি টিকিট সাঁটো তার কী লাভ? মিশরি টিকিট পেলে কি সে খুশি হবে না? তা-ও আবার দাদার চিঠিতে!
পার্সি আবার ভ্যাচর ভ্যাচর আরম্ভ করলে চুলকাটা সমস্যার সমাধান যখন আমি করে দিয়েছিলুম ঠিক সেইরকম- আমার সঙ্গে দেখা না হলে
আমি বললুম, ব্যস, ব্যস। আর শোনো, স্ট্যাম্প লাগাবার সময়, এক পয়সা, দু পয়সা, এক আনা, দুপয়সা করে করে চৌদ্দ পয়সার টিকিট লাগাবে–দুম করে শুধু একটা চৌদ্দ পয়সার টিকিট লাগিয়ো না। বোন তা হলে এক ধাক্কাতেই অনেকগুলি টিকিট পেয়ে যাবে।
ততক্ষণে পল এসে আমার সঙ্গ নিয়েছে। আস্তে আস্তে গুধাল, সোকোত্রা দ্বীপের কথা ওঠাতে আপনি কী ভাবছিলেন?
আমি বললুম, অনেক কিছু। এবং তার খানিকটে তাকে শুনিয়ে দিলুম।
পল দেখেছি পার্সির মতো সমস্তক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে মেতে থাকে না। মাঝে মাঝে জাহাজের এক কোণে বসে বই-টই পড়ে। তাই খানিকক্ষণ চুপ করে আমার কথাগুলো হজম করে নিয়ে বললে, বিষয়টা সত্যি ভারি ইনট্রেসটিঙ। সমুদ্রে সর্বপ্রথম কে আধিপত্য করলে, তার পর কে, তারাই-বা সেটা হারাল কেন, আজ যে মার্কিন আর ইংরেজ আধিপত্য করছে সেটাই-বা আর কতদিন থাকবে এবং তার পর আধিপত্য পাবে কে?
আমি একটু ভেবে বললুম, বোধহয়, আফ্রিকার নিগ্রোরা। ফিনিশিয়ান, গ্রিক, রোমান, ভারতীয়, চীনা, আরব, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ইত্যাদি যাবতীয় জাতই তো পালা করে রাজত্ব করলে একমাত্র ওরাই বাদ গেছে। এখন বোধহয় ওদের পালা। আর ম্যাপে দেখছ তো, কী বিরাট মহাদেশ, ওতে কোটি কোটি লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান স্ত্রী-পুরুষ গমগম করছে।
পল বললে, কিন্তু ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি?
আমি বললুম, সে তো দুই পুরুষের কথা। লেগে গেলে একশো বছরের ভিতর একটা জাত অন্য সবকটা জাতকে হারিয়ে দিতে পারে। বরঞ্চ পুরনো সভ্য জাত যারা আধমরা হয়ে গিয়েছে, তাদের নতুন করে বলিষ্ঠ প্রাণবন্ত করে রাজার আসনে বসানো কঠিন। একবার ছাঁচে ঢালাই করে যে মাল তৈরি করা হয়েছে তাকে ফের পিটে-টুকে নতুন আকার দেওয়া কঠিন– সেই তো হচ্ছে আজকের দিনের চীনা, ভারতীয় এবং আরও মেলা প্রাচীন জাতের নতুন সমস্যা।
পল জিগ্যেস করলে, ভারতীয়েরাও এককালে সমুদ্রে রাজত্ব করেছে নাকি?
আমি বললুম, সেকথা আজ প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু সে জন্য তাদের দোষ দেওয়া অনুচিত। কারণ, ভারতীয়েরা নিজেরাই সে ইতিহাসের সন্ধান রাখে না। অথচ আমার যতদূর জানা, তাতে তারা লাল দরিয়া থেকে চীনা সমুদ্র পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, শ্যাম, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়াতে রাজত্বও করেছে। তার পর একদিন আমাদের সমাজপতিরা সমুদ্রযাত্রা বারণ করে দিলেন খুব সম্ভব আমাদের সাম্রাজ্য বিস্তার তারা পছন্দ করেননি। তাই হয়তো তারা বলতে চেয়েছিলেন, যে দেশ জয় করছ তারই আর পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাও, আপন দেশে ফিরে আসার কোনও প্রয়োজন নেই।
পল বললে, আমার জীবনের এই ষোল বৎসর কাটল চীনে কিন্তু ভারতের সঙ্গে চীনের কখনও কোনও যোগ হয়েছিল বলে শুনিনি। শুধু শুনেছি বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে এসেছিল। কিন্তু সে তো কটমটে ব্যাপার!
আমি বললুম, অতিশয়। ও-পাড়া মাড়িয়ো না। কিন্তু চীন-ভারতের মধ্যে একবার একটি ভারি চমৎকার মজাদার দোস্তি হয়েছিল। শুনবে?
পল বললে, তা আর বলতে! কিন্তু পার্সিটা গেল কোথায়? কুকুরছানার মতো যেন সমস্তক্ষণ নিজের ল্যাজ খুঁজে বেড়ায়। ওরে, ও পার্সি!
.
জিরাফ কাহিনী
দিল্লিতে যখন পাঠান-মোগল রাজত্ব করত তখন সামান্যতম সুযোগ পেলেই বাঙলা দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার চেষ্টা করত। বাঙলার প্রধান সুবিধে এই যে, সেখানে নদী-নালা বিল-হাওর বিস্তর এবং পাঠান-মোগলের আপন পিতৃভূমি কিংবা দিল্লিতে ওসব জিনিস নেই বলেই তারা যখনই বিদ্রোহ দমন করতে এসে বাঙলার জল দেখত তখনই তাদের মুখে জল যেত শুকিয়ে। দেশটা পিছলে, অভ্যাস না থাকলে দাঁড়ানো কঠিন।
এইরকম একটা সুযোগ পেয়ে বাঙলার এক শাসনকর্তা স্বাধীন হয়ে রাজা হয়ে যান। রাজাটি একটু খামখেয়ালি ছিলেন। তা না হলে কোথায় ইরান আর কোথায় বাঙলা দেশ। তিনি সেখানে দূত পাঠালেন বিস্তর দামি দামি সওগাত সঙ্গে নিয়ে ইরানের সবচেয়ে সেরা কবি হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করার জন্য। চিঠিতে লিখলেন, হে কবি, তোমার সুমধুর তথা উদাত্ত কণ্ঠে তামাম ইরান দেশ ভরে গিয়েছে। ইরান ক্ষুদ্র দেশ, তোমার কণ্ঠস্কৃর্তির জন্য সেখানে আর স্থান নেই। পক্ষান্তরে ভারতবর্ষ বিরাট দেশ, এখানে এস, তোমার কণ্ঠস্বর এখানে প্রচুর জায়গা পাবে। তার সরল অর্থ, ইরানে আর কটা লোক তোমার সত্যকার কদর করতে পারবে এ-দেশের লোকসংখ্যা প্রচুর। এইখানে চলে এস।