উঠে যাওয়া মাত্রই আমি পলকে শুধালুম, এ কীরকম চিড়িয়া হে?
পল বললে, কলম্বোতে উঠেছেন। পকেটভর্তি দুনিয়ার সব টুকিটাকি, মিষ্টি-মিঠাই। যার সঙ্গে দেখা তাকেই কিছু-না কিছু একটা অফার করেন। কিন্তু এ পর্যন্ত তাকে কথা বলতে শুনিনি।
আমি বললুম, জিগ্যেস করে দেখতে হবে তো।
পল বললে, উত্তর কি পাবেন?
বললুম, ঠিক বলেছ, কাল রাত্রে তো পাইনি।
এঁর সম্বন্ধে যে এত কথা বললুম, তার কারণ এর সঙ্গে পরে আমাদের খুব বন্ধুত্ব জমে। গিয়েছিল; সেকথা সময় এলে হবে।
০৫. কলম্বো থেকে আদন বন্দর
০৫.
পল বিজ্ঞকণ্ঠে বললে, কলম্বো থেকে আদন বন্দর ২০৮২ মাইল রাস্তা। জাহাজে ছদিন লাগে। মাঝখানে দ্বীপ-টীপ নেই, অন্তত আমার ম্যাপে নেই। তবে আদনের ঠিক আগেই সোকোত্রা দ্বীপ। সেটা হয়তো দেখতে পাব।
আমি বললুম, যদি রাত্রিবেলা ওই জায়গা দিয়ে যাই তবে দেখবে কী করে? আর দিনের বেলা হলেও অতখানি পাশ দিয়ে বোধহয় জাহাজ যাবে না। তার কারণ বড় বড় দ্বীপের আশপাশে বিস্তর ছোট ছোট দ্বীপও জলের তলায় মাথা ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। এর কোনওটার সঙ্গে জাহাজ যদি ধাক্কা খায় তবে আর আমরা সামনের দিকে এগুব না– এগিয়ে যাব তলার দিকে।
এদিকে কথা বলে যাচ্ছি, ওদিকে আমার বার বার মনে হতে লাগল, সোকোত্রা নামটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমার বাবার মাসি-মেসোমশাই তাঁদের দুই ছেলেকে নিয়ে গত শতকের শেষের দিকে মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন এবং আমার খুব ছেলেবেলায় তাঁর কাছ থেকে সে ভ্রমণের অনেক গল্প আমি শুনেছিলুম। আমার এই দাদাটি ছিলেন গল্প বলার ভারি ওস্তাদ। রাত্রির রান্না না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের গল্প বলে দিব্যি জাগিয়ে রাখতে পারতেন এবং যেই চাচিরা খবর দিতেন, রান্না তৈরি, অমনি তিনি বেশ কায়দা করে গল্পটা শেষ করে দিতে পারতেন। আমরা টেরই পেতুম না, আমাদের সামনে তিনি একটা ন্যাজকাটা হনুমান রেখে চলে গেলেন। আমাদের মনে হত গল্পটা যেন একটা আস্ত ডানাকাটা পরী।
সেই দাদির মুখে শুনেছিলুম, সোকোত্রার কাছে এসে নাকি যাত্রীদের মুখ শুকিয়ে যেত। জলের স্রোতের তোড়ে আর পাগলা হাওয়ার থাবড়ায় জাহাজ নাকি হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়ত কোনও একটা ডুবন্ত দ্বীপের ঘাড়ে আর হয়ে যেত হাজারো টুকরোয় খান খান। কেউ-বা জাহাজের তক্তা, কেউ-বা ডুবন্ত দ্বীপের শ্যাওলা মাখানো পাথর আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ চিৎকার করত বাঁচাও, কিন্তু কে বাঁচায় কাকে, কোথায় আলো, কোথায় তীর। ক্রমে ক্রমে তাদের হাতের মুঠি শিথিল হয়ে আসত, একে একে জলের তলে লীন হয়ে যেত।
দাদি যেভাবে বর্ণনা দিয়ে যেতেন, তাতে আমি সবকিছু ভুলে দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে উঠতুম, দাদি বাঁচলেন না, দাদিও ডুবে গেলেন। মনেই হত না জলজ্যান্ত দাদি আমাকে কোলে বসিয়ে গল্প বলছেন। শেষটায় বলতেন, আমাদের জাহাজের কিছু হয়নি, এসব টেছিল অন্য জাহাজে। সে জাহাজে করে গিয়েছিলেন তোর বন্ধু ময়না মিয়ার ঠাকুর্দা। জানিস তো, তিনি আর ফেরেননি। খুদাতালা তাঁকে বেহেশতে নিয়ে গিয়েছেন। মক্কায় হজ্বের পথে কেউ যদি মারা যায় তবে তার আর পাপ-পুণ্যের বিচার হয় না, সে সোজা স্বর্গে চলে যায়।
দাদি এরকম গল্প বলে যেতেন অনেকক্ষণ ধরে আর একই গল্প বলতে পারতেন বহুবার। প্রতিবারেই মনে হত চেনা গল্প অচেনা রূপে দেখছি। কিংবা বলতে পার, দাদিবাড়ির রাঙা বউদিকে যেন কখনও দেখছি রাস-মণ্ডল শাড়িতে, কখনও বুলবুল-চশমে। (হায়, এসব সুন্দর সুন্দর শাড়ি আজ গেল কোথায়!)
দাদির গল্পের কথা আজ যখন ভাবি তখন মনে হয় দাদি তার বর্ণনাতে আরব্য উপন্যাসের সাহায্য বেশকিছু নিতেন। আরব্য উপন্যাসের রকম-বেরকমের গল্পের মধ্যে সমুদ্রযাত্রা, জাহাজডুবি, অচেনা দেশ, অজানা দ্বীপ সম্বন্ধে গল্প বিস্তর। সিন্দবাদ নাবিকের গল্প পড়ে মনে হয়, জলের পির বদর সাহেব যেন আইন বানিয়ে দিয়েছিলেন যে জাহাজ ডুববে সেটাতেই যেন সিন্দবাদ থাকে। বেচারি সিন্দবাদ!
আরব্য উপন্যাসে যে এত সমুদ্রযাত্রার গল্প, তার প্রধান কারণ, আরবরা এক কালে সমুদ্রের রাজা ছিল, আজ যেরকম মার্কিন-ইংরেজের জাহাজ পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে দেখা যায়। তবে কারণ বুঝতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। আরব দেশের সাড়ে তিন দিকে সমুদ্র, তাই আরবরা সমুদ্রকে ডরায় না, আমরা যেরকম পদ্মা-মেঘনাকে ডরাইনে, যদিও পশ্চিমারা গোয়ালন্দের পদ্মা দেখে হনুমানজির নাম স্মরণ করতে থাকে– বোধহয় লম্ফ দিয়ে পেরোবার জন্য। আরবদের পূর্বে ছিল রোমানরা বাদশা– আরবরা তাদের যুদ্ধে হারিয়ে ক্রমে ক্রমে তাদেরই মতো অবাধে অনায়াসে সমুদ্রে যাতায়াত আরম্ভ করল। ম্যাপে দেখতে পাবে, মক্কা সমুদ্র থেকে বেশি দূরে নয়। আরবরা তখন লাল দরিয়া পেরিয়ে মৌসুমি হাওয়ায় ভর করে ভারতবর্ষের সঙ্গে ব্যবসা জুড়ল।
এসব কথা ভাবছি এমন সময় হঠাৎ আবার সোকোত্রার কথা মনে পড়ে গেল। দাদিমার সোকোত্ৰা স্মরণ করিয়ে দিল গ্রিকদের দেওয়া সোকোত্রার নাম দিয়োকরিদেস, সঙ্গে সঙ্গে হুশ-হুঁশ করে মনে পড়ে গেল যে পণ্ডিতেরা বলেন এই দিয়োস্করিদে নাম এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ-সুখাধার থেকে। আরবরা যখন এই দ্বীপে প্রথম নামল তখন ভারতীয় বোম্বেটেদের সঙ্গে এদের লাগল ঝগড়া। সে ঝগড়া কতদিন ধরে চলেছিল বলা শক্ত কারণ আমাদের সমাজপতিরা তখন সমুদ্রযাত্রার বিরুদ্ধে কড়া কড়া আইন জারি করতে আরম্ভ করেছেন। আমার মনে হয় এদেশ থেকে কোনও সাহায্য না পাওয়াতে এরা ক্রমে ক্রমে লোপ পেয়ে যায়, কিংবা ওই দেশের লোকের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে এক হয়ে যায় যেরকম শ্যাম, ইন্দোচীন ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বহু শতাব্দীর আদান-প্রদানের পর একদিন আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। খুব সম্ভব ওই সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করারই ফলে। ভারতীয়েরা কিন্তু সোকোত্রায় তাদের একটি চিহ্ন রেখে গিয়েছে; সোকোত্রার গাই-গরু জাতে সিন্ধু দেশের। আশ্চর্য, সভ্যতার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিন্তু তার পোষা গরু-ঘোড়া শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থেকে তার প্রভুর কথা চক্ষুষ্মন ব্যক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মোগল-পাঠানের রাজত্ব ভারতবর্ষ থেকে কবে লোপ পেয়ে গিয়েছে কিন্তু তাদের আনা গোলাপ ফুল আমাদের বাগানে আরও কত শত শত বৎসর রাজত্ব করবে কে জানে!