বিলিতি কায়দা-কেতা যদিও আমি ভালো করে জানিনে তবু অন্তত এতটুকু জানি যে শুড় নাইট ওদেশে বিদায় নেবার অভিবাদন– আমরা যেরকম যে কোনও সময় বিদায় নিতে হলে বলি, তবে আসি। দেখা হওয়ামাত্রই কেউ যদি বলে, তবে এখন আসি তবে বুঝব লোকটা বাঙালি নয়। তাই তাঁর গুড নাইট থেকে অনুমান করলুম, ইনি যদিও বিলিতি বেশ ধারণ করেছেন তবু আসলে ভারতীয়।
আমি বললুম, বৈঠিয়ে।
আমার বাঁ দিকে পার্সির শূন্য ডেক-চেয়ার। তিনি তার-ই উপরে বসে পড়ে আমাকে বললেন, আমার নাম আবুল আসফিয়া নুর উদ্দিন মুহম্মদ আব্দুল করিম সিদ্দিকি।
আমার অজানাতেই আমি বলে ফেলেছিলুম, বাপস। কেন, সেকথা কি আর খুলে বলতে হবে? তবু বলি।
আমি মুসলমান। আমার নাম সৈয়দ মুজতবা আলী, আমার পিতার নাম সৈয়দ সিকন্দর আলী। আমার ঠাকুরদাদার নাম সৈয়দ মুশররফ আলী। ভারতীয় মুসলমানের নাম সচরাচর তিন শব্দেই শেষ হয়। তাই এর আড়াইগজি নামে যে আমি হকচকিয়ে যাব তাতে আর বিচিত্র কী?
বিবেচনা করি, তিনিও বিলক্ষণ জানতেন। কারণ চেয়ারে বসেই, তিনি তাঁর অন্যতম পকেট থেকে বের করলেন একটি সুন্দর সোনার কেস্। তার থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, নামটা একটু লম্বা। তাই এইটে নিন।
আমি তো আরও অবাক। ভিজিটিং কার্ডের কে হয় তা আমি জানি। কারণ, ভিজিটিং কার্ড সুন্দর সুচিকুণ। যাদের তা থাকে তাদের কেউ কেউ সেটা কেসে রাখেন। যেমন মনে কর, ইনশুওরেন্সের দালাল, খবরের কাগজের সংবাদদাতা কিংবা ভোটের ক্যানভাসার। কিন্তু ওঁদেরও তো কেস দেখেছি জর্মন সিলভারে তৈরি। ভিজিটিং কার্ডের সোনার কেস্ পূর্বে আমি কখনও দেখিনি।
সেই বিস্ময় সামলাতে না সামলাতেই তিনি আরেক পকেটে হাত চালিয়ে ডুবুরির মতো গভীর তল থেকে বের করলেন এক সোনার সিগারেট কে। ওরকম কে আমি শুধু স্বপ্নে আর সিনেমায় ফিলুস্টারদের হাতে দেখেছি, বাস্তবে এই প্রথম সাক্ষাৎ। ডেকের অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ আলোতেও সেটা যা ঝলমল করে উঠল তার সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় শুধু স্যাকরা-বাড়ি থেকে সদ্য-আসা গয়নার সঙ্গে। কেসের এক কোণে আবার কী যেন এক নীল রঙের পাথর দিয়ে আল্পনা এঁকে ইংরেজি অক্ষরে ভদ্রলোকের সেই লম্বা নামের গুটি দু তিন আদ্যক্ষর। কেসটি আবার সাইজেও বিরাট। নিদেনপক্ষে ত্রিশটি সিগারেট ধরবে। আমার সামনে কেসটি খুলে ধরে আরেক পকেট থেকে বের করলেন একটি লাইটার। তার উপর জয়পুরি মিনার কাজ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় জমিদারবাড়ির বড় গিন্নিমার কবচ কিংবা মাদুলি।
আমার মনের ভিতর দিয়ে হুড়-হুঁড় করে এক পলটন সেপাইয়ের মতো পঞ্চাশ সার প্রশ্ন চলে গেল।
তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এরকম লজঝড় কোট-পাতলুনের ভিতর অতসব সুন্দর সুন্দর দামি দামি জিনিস লোকটা রেখেছে কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, এমন সব দামি মাল যার পকেটে আছে, সে ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে, আমার মতো গরিবের সঙ্গে টুরিস্ট ক্লাসে যাচ্ছে কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন– তা সে যাক গে। কারণ সবকটা প্রশ্নের পুরো ফর্দ এখানে দিতে গেলে আমার বাকি দিনটা কেটে যাবে। আর তোমাদেরও বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, ভদ্রলোকের বর্ণনা শুনে তোমাদের মনেও সেইসব প্রশ্ন জাগবে যেগুলো আমার মনে জেগেছিল। তবে আর সেগুলো সবিস্তর বলি কেন?
কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই কী প্রকারে?
তিনি বয়সে আমার চেয়ে ঢেড় বড়। তিনি যদি আলাপচারী আরম্ভ না করেন তবে আমি তাঁকে প্রশ্ন শুধাই কী করে? মুরুব্বিদের আদেশ, ছেলেবেলা থেকেই শুনেছি, বড়রা প্রশ্ন জিগ্যেস করবেন– ছোটরা উত্তর দেবে। সে আদেশ লজ্জন করব কী করে? বিশেষ করে বিদেশে, যেখানকার কায়দা-কেতা জানিনে। সেখানে দেশের গুরুজনদের আদেশ স্মরণ করা ভিন্ন অন্য পুঁজি আছে কি?
আধ ঘন্টাটাক কেটে গিয়েছে। ইতোমধ্যে আমি তার দু-দুটো সিগারেট পুড়িয়েছি। ফের যখন তৃতীয়টা বাড়িয়ে দিলেন তখন আমাকে বেশ দৃঢ়ভাবে না বলতে হল। সঙ্গে সঙ্গে সাহস সঞ্চয় করে শুধালুম, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
যেন প্রশ্ন শুনতে পাননি। আমিও চাপ দিলুম না।
আমি খানিকক্ষণ পরে বললুম, মাফ করবেন, আমি শুতে চললুম, গুড নাইট। বললেন, গুড নাইট।
কী জানি, লোকটা কেন কথা বলে না। বোধহয় জিভে বাত হয়েছে। কিংবা হয়তো ওর দেশে কথা বলাতেও রেশনের আইন চলে। যাক গে, কী হবে ভেবে।
পরদিন সকালবেলা পল-পার্সিকে নিয়ে আমি যখন সংসারের যাবতীয় কঠিন কঠিন প্রশ্ন এবং সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত, এমন সময় সেই ভদ্রলোক এসে আবার উপস্থিত। আমি ওদের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিতেই তিনি তার আরেকটা পকেটে হাত চালিয়ে বের করলেন একরাশ সুইস চকলেট, ইংরেজি টফি এবং মার্কিন চুইংগাম। পল-পার্সি গুটি কয়েক হাতে তুলে নিয়ে যতই বলে, আর না, আর না, তিনি কিন্তু বাড়ানো হাত গুটোন না। ওদিকে মুখে কোনও কথা নেই। শেষটায় বিষণ্ণ বদনে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
আমরা খানিকটে ইতি-উতি করে পুনরায় নিজেদের গল্পে ফিরে গেলুম। তখন দেখি, ভাষণে অরুচি হলেও তিনি শ্রবণে কিছুমাত্র পশ্চাদপদ নন। আমাদের গল্পের মাঝে মাঝে তাগমাফিক হু, হা দিব্যি বলে যেতে লাগলেন। তার পর আমাদের তিনজনকে কিছুতেই লাইম স্কোয়াশ খাওয়াতে না পেরে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন।