দোকান-পাট বন্ধ। রাস্তার কারবারি ভিড় নেই। শহর-গ্রাম শাত, নিস্তব্ধ। তাই শোনা যাচ্ছে গির্জার ঘন্টা—জনপদ, হাটবাট, তরুলতা, ঘরবাড়ি সবই যেন গির্জার চুড়া থেকে ঢেলে-দেওয়া শান্তির বারিতে অভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছে।
চাচা থামলেন। বোধ করি বার্লিনের কলরবের মাঝখানে রাইনের সে ছবির বর্ণনা তার নিজের কাছেই অদ্ভুত শোনাল। খানিকটে ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু এহ বাহ্য। ক্যাথলিক ধর্ম ক্রিশ্চানের দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু ঠাই পেয়েছে জানিনে, কিন্তু গির্জার ভিতরে তার যে রূপ সে না দেখলে, না শুনলে বর্ণনা দিয়ে সে-জিনিস বোঝাবার উপায় নেই।
মানুষ তার হৃদয়, তার চিন্তাশক্তি, তার আশা-আকাঙক্ষা, তার শোকনৈরাশ্য দিয়ে বিরাট ব্রহ্মকে আপন করে নিয়ে কত রূপে দেখেছে তার কি সীমা-সংখ্যা আছে? ইহুদিরা দেখেছে যেহোভাকে তার রুদ্ররূপে, পারসিক দেখেছে আলো-আঁধারের দ্বন্দ্বের প্রতীক রূপে, ইরানি সুফী তাকে দেখেছে প্রিয়ারূপে, মরমিয়া বৈষ্ণব তাকে দেখেছে কখনও কৃষ্ণরূপে কখনও রাধারূপে, আর ক্যাথলিক তাকে দেখেছে মা-মেরির জননীরূপে।
তাই মা-মেরির দেবী-মূর্তি লক্ষ লক্ষ নরনারীর চোখের জল দিয়ে গড়া। আর্ত পিপাসার্ত বেদনাতুর হিয়া যখন পৃথিবীর কোনোখানে আর কোনো সান্ত্বনার সন্ধান পায় না, তখন তার শেষ ভরসা মা মেরির শুভ্র কোল। যে মা-মেরি আপন দেহজাত সন্তান কন্টকমুকুটশির যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় পলে পলে মরতে দেখলেন তার চোখের সামনে, তিনি কি এই হতভাগ্য কোটি কোটি নরনারীর হৃদয়বেদনা বুঝতে পারবেন না? নশ্বর দেহ ত্যাগ করে তিনি আজ বসে আছেন দিব্য সিংহাসনে—তার অদেয় কিছুই নেই, মানুষের অবারি সপ্তসিন্ধু হয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডতে হানা দিলেও তিনি সেসপ্তসিন্ধু মুহূর্তের ভিতরেই করাঙ্গুলি নির্দেশে শুকিয়ে দিতে পারেন। তাই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে ক্যাথলিক গির্জায় গির্জায়–
ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী। তুমি প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করেছ। রমণী জাতির মধ্যে তুমিই ধন্য, আর ধন্য তোমার দেহজাত সন্তান যীশু। মহিমাময়ী মা-মেরি, এই পাপীতাপীদের তুমি দয়া কর, আর দয়া কর যেদিন মরণের ছায়া আমাদের চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসবে।
কত হাজার বার শুনেছি আমি এই প্রার্থনা। এই আভে-মারিয়া’ উপাসনামন্ত্র খ্রষ্টবেরী ইহুদী সম্প্রদায়ের মেডেলজোনকে পর্যন্ত যে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল তারই ফলে মেভেলজোন সুর দিয়েছেন মেরিমকে। ক্যাথলিকরা সেই সুরে মেরিম গেয়ে বিশ্বজননীকে আবাহন করে অষ্টকুলাচলশিরে, সপ্তসমুদ্রের পারে পারে।
কত লক্ষবার শুনেছি আমি এই প্রার্থনা। পুরুষের সবলকঠে, বৃদ্ধার অর্ধস্ফুট অনুনয়ে, শিশুর সরল উপাসনায় মিলে গিয়ে যে মন্ত্র উচ্চারিত হয় সে মন্ত্র তখন আর শুধু ক্যাথলিকদের নিজস্ব প্রার্থনা নয়, সে প্রার্থনায় সাড়া দেয় সর্ব আস্তিক, সর্ব নাস্তিক।
হঠাৎ মন্ত্রোচ্চারণ ছাপিয়ে সমস্ত গির্জা ভরে ওঠে যন্ত্রধ্বনিতে। বিরাট অর্গান সুরের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে গির্জার শেষ কোণ, ভিজিয়ে দিয়েছে পাপীর শুষ্কতম হৃদয়। উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে উপরের দিকে সে-গম্ভীর যন্ত্ররব, আর তার সঙ্গে গেয়ে ওঠে সমস্ত গির্জা সম্মিলিত কঠে—
‘ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী।’
সেই ঊর্ধ্বদিকে উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত সঙ্গীতের প্রতীক ঊর্ধ্বশির ক্যাথলিক গির্জা। মানুষের যে-প্রার্থনা যে-বন্দনা অহরহ মা-মেরির শুভ্র কোলের সন্ধানে উপানে ধায় তারই প্রতীক হয়ে গির্জাঘর তার মাথা তুলেছে উর্বদিকে। লক্ষ লক্ষ গির্জার লক্ষ লক্ষ শিখর মা-মেরির দিব্যসিংহাসনের পার্থিব স্তম্ভ।
চাচা চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর চোখ মেলে গোঁসাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গোঁসাই, রবিঠাকুরের সেই গানটা গাও তো–
‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।’
গোঁসাই গুনগুন করে গান গাইলেন। গাওয়া শেষ হলে চাচা বললেন, গির্জার ক্যাথলিক ধর্মসঙ্গীত তোমরাও শুনেছ কিন্তু তার করুণ দিকটা কখনো লক্ষ্য করেছ কি না জানিনে।
একদিন যখন আমি এই ‘আভে মারিয়া’ সঙ্গীতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চিলের মত উপরের দিকে উঠে যাচ্ছি বাহ্যজ্ঞান প্রায় নেই—তখন হঠাৎ শুনি আমার পাশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। চেয়ে দেখি একটি মেয়ে চোখের জলে প্রেয়ার-বুক রাখার হইবে আর তার পায়ের কাছে খানিকটে জায়গা ভিজিয়ে দিয়েছে। অর্গান আর পাঁচশ’ গলার তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েটি আপন কান্না কেঁদে নিচ্ছে।
পুব-বাংলার ভাটিয়ালি গানে আছে রাধা ভেজা কাঠ জ্বালিয়ে ধুয়ো বানিয়ে কৃষ্ণবিরহের কান্না কাঁদতেন। শাশুড়ি-ননদী জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ধুয়ে চোখে ঢুকছে বলে চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে। শুনেছি বাঙালি মেয়েও নাকি নির্জনে কাঁদবার ঠাই না পেলে স্নানের ঘরে কল ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে হাউহাউ করে কাঁদে।
গির্জায় মেয়েটির কান্না দেখে আমি জীবনে প্রথম বুঝতে পারলুম, রাধার কান্না, বাঙালি মেয়ের কান্না কত নিরন্ধ্র অসহায়তা থেকে ফেটে বেরোয়।
তখন বুঝতে পারলুম, গির্জা থেকে বেরোবার সময় যে অনেক সময় দেখেছি এখানে-ওখানে জলের পোঁচ সে ছাতার জল নয়, মেঝে ধোওয়ার জলও নয়, সে জল চোখের জল।
কুরান শরীফে আছে কুমারী মরীয়ম (মেরি) যখন গর্ভযন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন তখন লোকচক্ষুর অগোচরে গিয়ে খেজুর গাছ জড়িয়ে ধরে তিনি লজ্জায় দুঃখে আর্তনাদ করেছিলেন, ইয়া লায়নি, মিতু বলা হাজা—হায়, এর আগে আমি মরে গেলুম না কেন? মানুষের চোখের থেকে মন থেকে তাহলে আমি নিস্তার পেতুম।