—————-
* কবিতাটির একটি ছত্র ইলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’ কবিতায় আছেঃ-
“Frisch weht der Wind
Der Heimat zu
Mein Irisch Kind,
Wo weilest du?”
তীর্থহীনা
ভারতবর্ষের লোক এককালে লেখাপড়া শেখবার জন্য যেত কাশী-তক্ষশিলা। মুসলমান আমলেও কাশী-মাহাত্ম্য কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি, ছাত্রের অভাবও হয়নি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আরবী-ফারসী শিক্ষারও দুটি কেন্দ্র দেওবন্দ আর রামপুরে গড়ে উঠল। ইংরেজ আমলে সবকটাই নাকচ হয়ে গিয়ে শিক্ষা-দীক্ষার মক্কা-মদিনা হয়ে দাঁড়াল অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ। ভটচায-মৌলবী কোন দুঃখে কাশী-দেওবন্দ উপেক্ষা করে ছেলে—এমন কি মেয়েদেরও বিলেত পাঠাতে আরম্ভ করলেন তার আলোচনা করে আজ আর লাভ নেই।
কিন্তু ১৯২১-এর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে উল্টো হাওয়া বইতে শুরু করল। অসহযোগী’ ছাত্রদের কেউ কেউ বিলেতে না গিয়ে গেল বার্লিন। এদের সংখ্যা বেড়ে বেড়ে শেষটায় ১৯২৯-এ এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যার উপর ভর করে একটা রেস্তোরাঁ চালান সম্ভবপর হয়ে উঠল। তাই বার্লিনে ‘হিন্দুস্থান হৌসে’র পত্তন।
সেদিন হিন্দুস্থান হোঁসের আচ্ছা ভালো করে জমছিল না। কোত্থেকে এক পাদ্রীসায়েব এসে হাজির। খোদায় মানুষ কে তাকে বলেছে, এখানে একগাদা হিদেন ঝামেলা লাগায়। প্রভু খ্রীষ্টের সুসমাচার শুনতে না শুনতেই এরা ঝাকে ঝাকে প্রভুর শরণ নেবে ও সুবে বালিনিস্থানে পাদ্রীসায়েবের জয়জয়কার পড়ে যাবে। অবশ্যি তার ভুল ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি। গোঁসাই সঙ্গীতরসম্ভ, আর এ-দুনিয়ার তাবৎ সঙ্গীতই গড়ে উঠেছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। কাজেই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তিনি বাবদে খানিকটা ওকিবহাল। বললেন, সায়েব, খ্রীষ্টধর্ম যে উত্তম ধর্ম তাতে আর কী সন্দেহ, কিন্তু আমাদের কাছে তো শুধু এই ধর্মটাই ভোট চাইছে না, হিন্দু-মুসলমান আরো দুটো ডাঙর কেভিডেট রয়েছে যে! গীতা পড়েছ?
তখন দেখা গেল পাত্রী করান পড়েনি, গীতার নাম শোনেনি, আর ত্রিপিটক উচ্চারণ করতে গিয়ে তিনবার হোঁচট খেল।
ঘন্টাখানেক তর্কাতর্কি চলেছিল। ততক্ষণে ওয়েট্রেস পাশের একটা বড় টেবিলে আড্ডার ডাল-ভাত-চচ্চড়ি সাজিয়ে ফেলেছে। চাচা পাত্রীকে দাওয়াত করলেন হিদেখানা চেখে দেখতে। সায়েব বিজাতীয় আহারের দিকে একটিবার নজর বুলিয়েই অনেক ধন্যবাদ দিয়ে কেটে পড়ল।
চাচা বললেন, ‘দেখলি, অচেনা রান্না পরখ করে দেখবার কৌতূহল যার নেই সে যাবে অজানা ধর্মের সন্ধানে! গোঁসাই, তুমি বৃথাই শক্তিব্যয় করছিলে।
সূয্যি রায় মাস্টার্ড পেতলে নিয়ে কাসুন্দীর মতো করে লুচির সঙ্গে খেতে খেতে বললেন, ব্যাটা গ্যেটেও পড়েনি নিশ্চয়। গ্যেটে বলেছেন, ‘যে বিদেশ যায়নি সে কখনো স্বদেশের স্বরূপ চিনতে পায়নি।’ ধর্মের বেলাও তাই।
চাচা বললেন, কিন্তু অনেক কঠিন। ধর্মের গতি সূক্ষ্ম, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার জন্য স্থূল ট্রেন রয়েছে, স্থূলতর জাহাজ রয়েছে, আর টমাস কুকরা তো আছেই। বিদেশে নিয়ে যাবার জন্য ওরাই সবচেয়ে বড় আড়কাঠি, অর্থাৎ মিশনরি। আর এতই পাকা মিশনরি যে ওরা সকলের পকেটে হাত বুলিয়ে দুপয়সা কামায়ও বটে। কিন্তু ধর্মের মিশনরিদের হল সবচেয়ে বড় দেউলে প্রতিষ্ঠান।
লেডি-কিলার পুলিন সরকার বলল, কিন্তু কী দরকার বাওয়া এসব বখেড়ার? বার্লিন শহরটা তো ধর্ম বাদ দিয়েও দিব্যি চলছে।
চাচা বললেন, ‘বাদ দিতে চাইলেই তো আর বাদ দেওয়া যায় না। শোন।
আমি যখন রাইনল্যান্ডের গোডেবের্গ শহরে ছিলুম, তখন ক্যাথলিক ধর্মের সঙ্গে আমার অল্প অল্প পরিচয় হতে আরম্ভ হল। না হয়ে উপায়ও নেই। বার্লিনের হৈ-হুলোড় গির্জেগুলোকে ধামা চাপা দিয়ে রেখেছে আর রাইনল্যান্ডের গির্জার সঙ্গীত তামাম দেশটাকে বন্যায় ভাসিয়ে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘দাঁড়ায়ে বাহির দ্বারে মোরা নরনারী
উৎসুক শ্রবণ পাতি শুনি যদি তারি
দুয়েকটি তান—’
এতো তাও নয়। এখানে সমস্ত দেশব্যাপী সঙ্গীতবন্যা আর তার মাঝখানে আমি ক্যাথলিক নই বলে শাখামৃগের মতো একটা গাছের ডগা আঁকড়ে ধরে বসে প্রাণ বাঁচাব এ ব্যবস্থা আমার কিছুতেই মনঃপূত হল না তার চাইতে বাউলের উপদেশই ভালো, ‘যে জন ডুবলো সখী, তার কি আছে বাকি গো?
সমস্ত সপ্তাহের অফুরন্ত কাজ, অস্বাভাবিক উত্তেজনা, বার্লিনের লোক খানিকটে ঠাণ্ডা করে সারা রবির সকাল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। কিন্তু রাইনের জীবন বিলম্বিত একতালে। তাই রবির সকাল রাইনের দ্রষ্টব্য বস্তু।
কাচ্চা-বাচ্চারা চলেছে রঙ-বেরঙের জামাকাপড় পরে, কতকগুলো করছে কিচিরমিচির, কতকগুলো বা মা-বাপের কথামতো গির্জার গাম্ভীর্য জোর করে মুখে মাখবার চেষ্টা করছে, মেয়েরা যেতে যেতে দোকানের শার্সিতে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হ্যাটটা আধ ইঞ্চি এ-দিক ওদিক করে নিচ্ছে, গ্রামভারি গাওবুড়োরা রবিবারের নেভিবু সুট পরে চলেছেন গিন্নীদের সঙ্গে ধীরে-মন্থরে, আর যে সব অথর্ব বুড়ো-বুড়ি সপ্তাহের ছদিন ঘরে বসে কাটান তারা পর্যন্ত চলেছেন লাঠিতে ভর করে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে, অথবা হুইলচেয়ারে বসে ছেলে-ভাইপোর মোলায়েম ঠেলা খেয়ে খেয়ে বাচ্চারা যেরকম-ধারা পেরেম্বুলেটরে করে হাওয়া খেতে বেরোয়। জোয়ানদের ভিতর গির্জায় যায় অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু যারা যায় তাদের মুখে ফুটে উঠেছে প্রশান্ত ভাব—এরা গির্জার কাছ থেকে এখন অনেক কিছু আশা করে, ধর্ম এখনো তাদের কাছে লোকাঁচার হয়ে যায়নি।