হের ওবের্স্ট বললেন, না বনাই ভালো। এ রকম ধ্বংসমুখ দেশ পৃথিবীতে আর দুটো নেই। প্যারিসের উন্মত্ত উজ্জ্বল বিলাস দেখেছেন? কোনো সুস্থ জাতির পক্ষে এরকম নির্লজ্জ কাণ্ডজ্ঞানহীনতা সম্ভব?
আমি বললুম, ‘বার্লিনেও কাবারে’ আছে।
হের ওবের্স্ট বললেন, বার্লিন জর্মনি নয়, প্রাশার প্রতীক নয়, কিন্তু প্যারিস ফ্রান্স এবং ফ্রান্স প্যারিস।
আমি চুপ করে ভাবতে লাগলুম। হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। যে-সমস্যা মানুষের মনকে অহরহ আন্দোলিত করে, শেষ পর্যন্ত সে-সমস্যা নিজের জীবনে, নিজের পরিবারের জীবনে কতটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তাই নিয়ে মানুষ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় একদিন না একদিন আলোচনা করে। হের ওবের্স্টকে কখনো আলোচনার সে দিকটা মাড়াতে দেখিনি।
ফ্রাউ ডুটেন্হফারকে আমি অধিকাংশ সময় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গল্পকাহিনী বলতুম। হের ওবের্স্টের তুলনায় যদিও তার সঙ্গে দেখা হত কম, তবু তার সঙ্গে হৃদ্যতা হয়েছিল বেশি। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘হের ওবের্স্টের সঙ্গে নানা আলোচনা হয়, কিন্তু আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, না জেনে হয়তো আমি এমন বিষয়ের কথা পাড়ব যাতে তার আঘাত লাগতে পারে। আমার বিশ্বাস তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন—তাই এ-প্রশ্ন শুধালুম।’
ফ্রাউ ডুটেহকার অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মুখের ভাব থেকে মনে হল তিনি মনে মনে বলি কি বলি না’ করছেন। শেষটায় ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের পরিবারের কথা কখনো পাড়বেন না। আমাদের যোল বছরের ছেলেটি ফ্রান্সের লড়াইয়ে মারা গেছে, আমাদের মেয়ে—
কথার মাঝখানে ফ্রাউ ডুটেনহফার হঠাৎ দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কেঁদে উঠলেন। এই বেকুব গোমূখামির জন্য আমি মনে মনে নিজেকে খুব জুতো-পেটা করলুম। অতটা বুদ্ধি কিন্তু তখনো ছিল যে এ সব অবস্থায় সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলে বিপদ বাড়িয়ে ভোলা হয় মাত্র। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। প্রাশানরা হয়তো তখনো হিল ক্লিক করে।
বড় ছেলে মরে যাওয়াতে বয়স্ক চাষাকে একদম ভেঙে পড়তে দেখেছি। তার তখন দুঃখ সে মরে গেলে তার খেত-খামার দেখবে কে। সভ্যতা কুলটুরের পয়লা কাতারের শহরে তারি পুনরাবৃত্তি দেখলুম ভুটেনহার পরিবারে। এত ঐতিহ্য, এত সাধনা, এত ভবিষ্যতের স্বপ্ন সব এসে শেষ হবে এই ডুটেহফারে?
তাই কি এত কৃচ্ছসাধন, রক্তসংমিশ্রণের বিরুদ্ধে এত তীব্র হুঙ্কার? যে বর্ষায় সফল বৃষ্টি হয় না সেই বর্ষাতেই কি দামিনীর ধমক, বিদ্যুতের চমক বেশি?
তাই হের ওবের্স্টের পড়াশুনোরও শেষ নেই। সভ্য অসভ্য বর্বর বিদগ্ধ দুনিয়ার তাবৎ জাতির নৃতত্ত্ব, সমাজগঠন, ধর্মনীতি পড়েই যাচ্ছেন, পড়েই যাচ্ছেন। শীতের রাতে আগুন না জ্বালিয়ে ঘরের ভিতর ঘন্টার পর ঘন্টা পাইচারি, বসন্তে বেখেয়ালে বৃষ্টিতে জবজব হয়ে বাড়ি ফেরা, গ্রীষ্মের সুদীর্ঘ দিবস বিদেশী মুসলমানকে প্রাশান ধর্মের মূল তত্ত্বে ওকিবহাল করার অন্তহীন প্রয়াস, হেমন্তের পাতা-ঝরার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে না জানি কোন নিষ্ফল বৃক্ষের কথা ভেবে ভেবে চিত্তের লুকানো কোণে দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ।
কিন্তু আমার সামনে তিনি কখনো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেননি। এসব আমার নিছক কল্পনাই হবে।
এক বৎসর ঘুরে এল। আমি ততদিনে পুরো পাক্কা প্রাশান হয়ে গিয়েছি। চেয়ারে হেলান না দিয়ে বসি, সুপে গোলমরিচের গন্ধ পেলে ঝাড়া পনেরো মিনিট হাঁচি, একটানা বারো ঘন্টা কাজ করতে পারি, তিন দিন না ঘুমুলেও চলে—যদিও কৃচ্ছ্বসাধনের ফলে আমার নিদ্রাকৃচ্ছুতা তখন অনেকটা সেরে গিয়েছে—কাঠের পুতুলের মতো খটখট করে হাঁটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে, আর আমার জর্মন উচ্চারণ শুনে কে বলবে আমি ভাত-খেকো, নেটিব, কালা-আদমী। সঙ্গে সঙ্গে এ-বিশ্বাসও খানিকটে হল যে হের ওবের্স্টের হৃদয় বলে যদি কোনো রক্তমাংসে গড়া বস্তু থাকে, তবে তার খানিকটে আমি জয় করতে পেরেছি।
এমন সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে আমার জীবনের প্রাশান-পর্বকে তার কুরুক্ষেত্রে পৌঁছিয়ে দিল।
কলেজ থেকে ফিরেছি। দোরের গোড়ায় দেখি একটি যুবতী পেরেমবুলেটরের হ্যান্ডেলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন। চেহারাটি ভারি সুন্দর, হুবহু হের ওবের্স্টের মতো। তিনিও সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে কথা নেই। আমিও দাঁড়ালুম, প্রাশান এটিকেট যদিও সে-অবস্থায় কাউকে সেখানে দাঁড়াতে কড়া বারণ করে। তবুও যদি কেউ দাঁড়ায় তবে সেই প্রাশান এটিকেটেরই অলঙ্ঘ্য আদেশ, হের ওবের্স্ট তাকে মহিলাটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। তিনি এটিকেট লঙ্ঘন করলেন—সেই প্রথম আর সেই শেষ।
আমি তখন আর প্রাশান না। আমার মুখোস খসে পড়েছে। আমি ফের কালা-আদমী হয়ে গিয়েছি। আমি নড়ব না।
মেয়েটি কী বললেন বুঝতে পারলাম না।
হের ওবের্স্ট বললেন, ‘তোমাকে আমি একবার বলেছি, আমার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনা করার চেষ্টা করবে না। তাই আর এক বার, শেষবারের মতো বলছি, তুমি যদি আবার এরকম চেষ্টা করো, তবে আমাকে বাধ্য হয়ে তোমার সন্ধানের বাইরে যেতে হবে।
আমি আর সেখানে দাঁড়ালুম না। ছুটে গেলুম ফ্রাউ ডুটেনহফারের কাছে। বললুম, আপনার মেয়ে দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে। আপনার স্বামী তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
তিনি পাথরের মতো বসে রইলেন। আমি তাকে হাত ধরে তুলে সদর দরজার দিকে নিয়ে চললুম। করিডরে শুনি দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। দেখি, হের ওকে ফিরে আসছেন। আমি তখন ফ্রাই ডুটেহফারের হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটলুম মেয়েটির সন্ধানে। তাকে পেলুম বাড়ির সামনের রাস্তায়। তখনো কাঁদছেন। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলুম, তার ঠিকানা টুকে নিয়ে এলুম।