পূর্ণ এক বৎসর ধরে এই লোকটির সাহচর্য পেয়েছি, তার সংযম দেখে মুগ্ধ হয়েছি মদ না, সিগরেট না, কফি না। বার্লিনের মেরুমুক্ত হিমে মুক্ত বাতায়ন নিরিন্ধন গৃহে ত্রিযামা-যামিনী বিদ্যাচর্চা, আত্মসম্মান রক্ষার্থে পিতৃপিতামহসঞ্চিত আশৈশব শ্রদ্ধাবিজড়িত প্রিয়বস্তু অকাতরে বিসর্জন, আহারে বিরাগ, ভাষণে অরুচি, দন্তহীন, দৈন্যে নীলকণ্ঠ, গুড়াকে—সব কিছু নিয়ে এঁর ব্যক্তি আমাকে এমনি অভিভূত করে ফেলেছিল যে আমি নিজের অজানায় তাকে অনুকরণ করতে আরম্ভ করেছিলুম। ডুটেন্ফারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আমি যে দস্তানা, অভারকোট, টাই, কলার ছাড়লুম, আজো তা গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করিনে। কিন্তু কিসে আর কিসে তুলনা করছি!
চাচা বললেন, শুধু একটা জিনিসে হের ওবের্স্টের চিত্তগতি আমি ধরতে পেরেছিলুম। আমাদের আলাপের দ্বিতীয় দিনে জিনিয়স সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে জাতিভেদের কথা ওঠে। আমি মুসলমান, তার উপর ছেলেবেলায় দু হাত তফাতে দাঁড়িয়ে বামুন পণ্ডিতকে শ্লেট দেখিয়েছি, কৈশোরে হিন্দুহস্টেলে বেড়াতে গিয়ে ঢুকতে পাইনি, জাতিভেদ সম্বন্ধে আমার অত্যধিক উৎফুল্ল হওয়ার কথা নয়। তারই প্রকাশ দিতে হের ওবের্স্ট জাতিভেদের ইতিহাস; তার বিশ্লেষণ, বর্তমান পরিস্থিতি, ভিন্ন ভিন্ন দেশে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ সম্বন্ধে এমনি তথ্য এবং তত্তে ঠাসা কতকগুলো কথা বললেন যে আমার উম্মার চোদ্দ আনা তখনি উবে গেল। দেখলুম, শুধু যে তিনি মনুসংহিতার জর্মন অনুবাদ ভালো করে পড়েছেন তা নয়, গৃহ্য ও শ্ৰেীতসূত্রের তাবৎ আচার অনুষ্ঠান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অধ্যয়ন করেছেন—অবশ্য সংস্কৃতে নয়, হিলেব্রান্টের জর্মন অনুবাদে। এসব আচারঅনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য কী, বৈজ্ঞানিক পরশপাথর দিয়ে বিচার করলে তার কতটা গ্রহণীয় কতটা বর্জনীয়, বিজ্ঞান যেখানে নীরব সেখানে কিংকর্তব্য এসব তো বললেনই, এবং যে সব সমস্যায় তিনি স্বয়ং কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে-সবগুলোও বিশেষ উৎসাহে আমার সামনে উপস্থিত করলেন।
অথচ কী বিনয়ের সঙ্গে দিনের পর দিন এই কথাটি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন প্রাশান কৌলীন্য যেন দম্ভপ্রসূত না হয়। প্রাশান কৌলীন্য জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দাবী করে না, তার দাবী শুধু এইটুকু যে তার বিশেষত্ব আছে। সে-বিশেষত্বটুকুও যদি পৃথিবী স্বীকার না করে, তাতেও আপত্তি নেই, কিন্তু অন্ততপক্ষে পার্থক্যটুকু যেন স্বীকার করে নেয়। হের ওবের্স্ট তাতেই সন্তুষ্ট। তিনি সেইটুকুই বাঁচিয়ে রাখতে চান। তার দৃঢ় বিশ্বাস, সে-পার্থক্যের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে।
এবং সেই পার্থক্যটুকু বাঁচিয়ে রাখবার জন্য দেখতে হবে রক্তসংমিশ্রণ যেন না হয়।
নীটশের সুপারম্যান?
না, না। শুধু বড় হওয়ার জন্য বড় হওয়া নয়, শুধু সুপার হওয়ার জন্য সুপার হওয়া নয়। প্রাশান আদর্শ হবে ত্যাগের ভিতর দিয়ে, আত্মজয়ের ভিতর দিয়ে ইয়োরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সেবক হওয়ার।
এবং যদি দরকার হয়, তার জন্য সংগ্রাম পর্যন্ত করা। সেবা করার জন্য যদি দরকার হয় তবে যে-সব অজ্ঞ, মূর্খ, অন্ধ তার অন্তরায় হয় তাদের বিনাশ করা।
আমার কাছে বড় আশ্চর্য ঠেকল। সেবার জন্য সংগ্রাম, বাঁচবার জন্য বিনাশ?
হের ওবের্স্ট বলতেন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কেন যুদ্ধ করতে বলেছিলেন? সেইটে বার বার পড়তে হয়, বুঝতে হয়। ভুললে চলবে না, জীবনের সমস্ত চিন্তাধারা কর্মপদ্ধতি লোকসেবায় যেন নিয়োজিত হয়।
আমি প্রথম দিনের আলোচনার পরই বুঝতে পেরেছিলুম হের ওবের্স্টের সঙ্গে তর্ক করা আমার ক্ষমতার বহু, বহু ঊর্ধ্বে কিন্তু এই ‘সেবার জন্য সংগ্রাম’ বাক্যটা আমার কাছে বড়ই আত্মঘাতী, পরস্পরবিরোধী বলে মনে হল। রক্তসংমিশ্রণ ঠেকাবার জন্য প্রাণবিসর্জন, এও যেন আমার কাছে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি মনে হল। আমার কোন কোন জায়গায় বাধছে হের ওবের্স্টের কাছে সেগুলোও অজানা ছিল না।
লক্ষ্য করলুম, এঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বল্পভাষণে। কিন্তু স্বল্প হলে কী হয়, শব্দের বাছাই, কল্পনার ব্যঞ্জনা, যুক্তির ধাপ এমনি নিরেট ঠাসবুনুনিতে বক্তব্যগুলোকে ভরে রাখত যে সেখানে সূচ্যগ্র ঢোকাবার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। এবং আরো লক্ষ্য করলুম যে একমাত্র রক্তসংমিশ্রণের ব্যাপারেই তিনি যেন ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
বিষয়টি যে তাঁর জীবনের কত বিরাট অংশ দখল করে বসে আছে সেটা বুঝতে পারলুম একদিন রাত প্রায় দুটোর সময় যখন তিনি আমার ঘরে এসে বললেন, এত রাতে এলুম, কিছু মনে করবেন না। আমাদের আলোচনার সময় একটি কথা আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, সেটি হচ্ছে, সুখদুঃখ, জয়পরাজয়, লাভক্ষতি যিনি সমদৃষ্টিতে দেখতে পারেন, একমাত্র তারই অধিকার সেবার ভার গ্রহণ করার, সেবার জন্য সংগ্রাম করার।
কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে হিল-ক্লিকের সঙ্গে বাও’ করে বেরিয়ে গেলেন।
এত রাত্রে এসে এইটুকু বলার এমন কী ভয়ঙ্কর প্রয়োজন ছিল?
হের ওবের্স্টের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি, বাড়ির সনে পাইচারি করেছি, পৎসদাম পেরিয়ে ছোট ছোট গ্রামে গিয়ে চাষাদের বাড়িতে খেয়েছি, পুরোনো বইয়ের দোকানে প্রাচীন মাসিক ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, অধিকাংশ সময় তিনি চুপ, আমিও চুপ। তাকে কথা বলাতে হলে প্রাশান ঐতিহ্যের প্রস্তাবনা করাই ছিল প্রশস্ততম পন্থা। একদিন শুধালুম, ফ্রান্সের সঙ্গে আপনাদের বনে না কেন?