আমি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। ফন্ ব্রাভেল আমার কাঁধে দিলেন এক গুত্তা। ঝপ করে ফের বসে পড়লুম। বললেন, ‘ডু ক্লাইনার ইডিয়োট (হাবাগঙ্গারাম), এখখুনি তোমার ফোন করে বলে দেওয়া উচিত, তোমার দ্বারা ওসব হবে-টবে না।
আমি বললুম, হিম্মৎ সিং থাকলে যা করতেন, আমার তাই করা উচিত।
ফন্ ব্রাভেল বললেন, ঈসপের গল্প পড়নি? ব্যাঙ ফুলে ফুলে হাতি হবার চেষ্টা করেছিল। হিম্মৎ সিংয়ের পক্ষে যা সরল, তোমার পক্ষে তা অসম্ভব। তাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি—হকি খেলায় তিনি আমাদের তালিম দিতেন। তার দাড়ি-গোঁফ নিয়ে তিনি পঁচিশখানা বিয়ে করতে পারতেন, দুটো হারেম পুষতে পারতেন। পারো তুমি?
আমি বললুম, গিব্রিয়ডফ বড় বিপদে পড়েছেন। আমার তো কর্তব্যজ্ঞান আছে!
ফন্ ব্রাভেল বললেন, যে মেয়ে মস্কো থেকে পালিয়ে বার্লিন আসতে পারে, তার পক্ষে বার্লিন থেকে প্যারিস যাওয়া ছেলেখেলা। রুশ সীমান্তের পুলিশের হাতে থাকে মেশিনগান, জর্মন সীমান্তের পুলিশের হাতে রবরের ডাণ্ডা।
আমি যতই যুক্তিতর্ক উত্থাপন করি তিনি ততই হাসেন, আর এমন চোখাচোখা উত্তর দেন যে আমার তাতে রাগ চড়ে যায়। শেষটায় বললুম, আপনি পুরুষ হলে বুঝতে পারতেন, যুক্তিতর্কের উপরেও পুরুষের কর্তব্যজ্ঞান নামক ধর্মবুদ্ধি থাকে।
ফন্ ব্রাভেল গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি যে পুরুষ তাতে আর কী সন্দেহ! সোজা বলে ফেল না কেন সুন্দরী দেখে সেই পুরুষের চিত্তচাঞ্চল্য হয়েছে।
আমি আর ধৈর্যধারণ করতে পারলুম না। বেরবার সময় শুনতে পেলুম ফন্ ব্রাভেল বলছেন ‘বিয়ের কেক-শ্যাম্পেন অর্ডার দিয়ে না কিন্তু! বিয়ে হবে না।
একেই তো আমার দুর্ভাবনার কূলকিনারা ছিল না, তার উপর ফন্ ব্রাথেলের ব্যঙ্গ। মনটা একেবারে তেতো হয়ে গেল। শরৎ চাটুয্যের নায়করাই শুধু যত্রতত্র ‘দিদি’ পেয়ে যায়, আমার কপালে ঢুঢ়ু।
সোজা বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়লুম। অন্ধকারে শিস দিয়ে মানুষ যেরকম ভূতের ভয় কাটায় আমি তেমনি হিম্মৎ সিংয়ের প্রিয় দোহাটি আবৃত্তি করতে লাগলুম:
‘এহসান নাখুদাকা উঠায় মেরী বলা
কিস্তি খুদা পর ছোড় দু লঙ্গরকো তোড় দুঁ।’
‘মাঝি আমায় সব বিপদ-আপদ থেকে বাঁচাবে এই আমার ভরসা?
নৌকো খুদার নামে ভাসালুম, নোঙর ভেঙে ফেলে দিয়েছি।
পরদিন পাঁচটার সময় কাফে ক্যোনিকে গিয়ে বসলুম। জানা ছিল, ফাসির পূর্বে খুনীকে সাহস দেবার জন্য মদ খাইয়ে দেওয়া হয়। হিম্মৎ সিং আমাকে কখনো মদ খেতে দেননি। ভাবলুম, তার ফঁসিতে যখন চড়ছি তখন খেতে আর আপত্তি কী?
গোলাম মৌলা অবাক হয়ে শুধাল, ‘মদ খেলেন?
চাচা বললেন, ‘কেনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয়নি।
সোয়া পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা, ছ’টা বাজল। ফ্রাউ রুবেন্স, ফ্রলাইন গিব্রিয়ডফ কারো দেখা নেই। এর অর্থ কী? জর্মনরা তো কখনো এরকম লেট হয় না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। যাই হয়ে থাকুক না কেন, আমি পালাই।
বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে ল্যান্ডলেডিকে জিজ্ঞেস করলুম, ফ্রাউ রুবেন্স ফোন করেছিলেন কি? না। আমার উচিৎ তখন ফোন করা। অনুসন্ধান করা, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? কিন্তু চেপে গেলুম। নোঙর যখন ভেঙে ফেলে দিয়েছি তখন আমি হালই বা ধরতে যাব কেন?
সাতদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছিলুম। রাত্রে শুতে যাবার সময় একবার ল্যান্ডলেডিকে চিচি করে জিজ্ঞেস করতুম, কোনো ফোন ছিল কি না। ল্যান্ডলেডি নিশ্চয় ভেবেছিল আমি কারো প্রেমে পড়েছি। প্রেমের দ্বিতীয় অঙ্কে নাকি মানুষ এরকম করে থাকে।
কোনো ফোনও না।
করে করে তিন মাস কেটে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কাজকর্মে মন দিলুম।
নটেগাছটি মুড়িয়ে দিয়ে চাচা চেয়ারে হেলান দিলেন।
ভোজের শেষে সন্দেশ-মিষ্টি না দিলে বরযাত্রীদের যে রকম হন্যে হয়ে ওঠার কথা, আমরা ঠিক সেইরকম একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম। মুখুয্যে বলল, কিন্তু ওনারা সব এলেন না কেন, তার তো কোনো হদিশ পাওয়া গেল না।
সরকার বলল, আপনার শেষরক্ষা হল বটে, কিন্তু গল্পটির শেষরক্ষা হল না।
রায় কঁদ-কাঁদ হয়ে বললেন, ‘নোঙর-ভাঙা নৌকোতে আমাকে ফেলে আপনি কেটে পড়লেন চাচা? আমার উদ্ধারের উপায় বলুন।
চাচা বললেন, মাসতিনেক পরে দস্তানা কিনতে গিয়েছি তীৎসে’। জর্মনদের হাতের তুলনায় আমাদের হাত ছোট বলে লেডিজ ডিপার্টমেন্টে আমাদের দস্তানা কিনতে হয়। সেখানে ফন্ ব্রাথেলের সঙ্গে দেখা। কানে কানে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হে পুরুষপুঙ্গব, এখানে কেন? নিজের জন্য দস্তানা কিনছ, না বউয়ের জন্য? কিন্তু বউ কোথায়? আমি উম্মাভরে গটগট করে চলে যাচ্ছিলুম, ফন্ ব্রাভেল আমার হাতটি চেপে ধরলেন— ‘বুলি’র সময় হকিস্টিক যেরকম চেপে ধরেন।
সেই কাফে ক্যোনিকেই নিয়ে বসালেন।
বললেন, ‘আমি সেদিন পাঁচটার সময় কাফের উপরের গ্যালারিতে বসে তোমাকে লক্ষ্য করছিলুম।
আমি তো অবাক।
বললেন, ‘ওরা কেউ এল না বলে তোমার সঙ্গে কথা না বলে চলে গেলুম। কিন্তু তারা এল না কেন জান? তবে শোননা। তোমার মতো মুখকে বাঁচাননা আমার কর্তব্য মনে করে আমি তাদের সঙ্গে লড়েছিলুম। হিম্মৎ সিং আমার বন্ধু, আমার পিতারও বন্ধু। তার প্রতি এবং তার প্রতেজে তোমার প্রতি আমারও কর্তব্য আছে।
তোমার কাছ থেকে সব কথা শুনে আমি সোজা চলে যাই ফ্ৰাউ রুবেসের ওখানে। তাকে রাজি করাই আমাকে গিব্রিয়াডফের ওখানে নিয়ে যাবার জন্য। সময় অল্প ছিল বলে, এবং ইচ্ছে করেই, ফোন করে যাইনি। গিয়ে দেখি সেখানে একপাল ষাঁড়ের সঙ্গে সুন্দরী শ্যাম্পেন খাচ্ছেন, হৈহল্লা চলছে। ফ্রাউ রুবেসের চক্ষুস্থির। তিনি গিব্রিয়ডফ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্য ধারণা করেছিলেন–ইংরেজিতে যাকে বলে ডেমজে ই ডিসট্রেস্ (বিপন্না)। সে কথা থাক—আমি দু’জনকে সামনে বসিয়ে পষ্টাপষ্টি বললুম যে তোমাতেআমাতে প্রেম, বিয়ে স্থির—আমি অন্য কোনো মেয়ের নোসেন্স সহ্য করব না।