চাচা বললেন, অন্য যে-কোনো অবস্থায় হলে আমি ফ্রাউ রুবেন্সকে একটা ঠিক উত্তর দেবার চেষ্টা করতুম, কিন্তু তখন কোনো উত্তরই দিতে পারলুম না। তোরা জানিস আনি স্নেহ-প্রেম-দয়ামায়াকে বুদ্ধিবৃত্তি-আত্মজয়ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি দাম দিই। কাজেই ফ্রাউ রুবেসের আঘাতটা আমার কতখানি বেজেছিল তার খানিকটে অনুমান তোরা করতে পারবি। কোনো চোখা উত্তর যে দিইনি তার কারণ, ততখানি চোখা জর্মন আমি তখন জানতুম না।
ঘড়েল মাস্টারগুলো জানে যে ছাত্র যখন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন তাকে ভালো করে নির্যাতন করার উপায় হচ্ছে চুপ করে উত্তরের প্রতীক্ষা করা। ফ্রাউ রুবেন্স সেটা চরমে পৌঁছিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি তা হলে হিম্মৎ সিংয়ের ঋণ শোধ করতে চান না?
রায়ের বিয়ার এসে গিয়েছে। চুমুক দিয়ে বললেন, ‘চাচা, মাপ করুন। আপনার কেস অনেক বেশি মারাত্মক।’
চাচা রায়ের কথায় কান না দিয়ে বললেন, ‘সেই বে-ইজ্জতিরও যখন আমি কোনো উওর দিলুম না তখন ফ্রলাইন গিব্রিয়ডফ হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। কুণ্ডলী-পাকানো গোখরো সাপকে আমি এরমধারা হঠাৎ খাড়া হতে দেখেছি। গিব্রিয়াডফের মুখ লাল, কালো চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে, সে আগুনের আঁচ ব্লন্ড চুলে লেগে চুলও যেন লাল হয়ে গিয়েছে।
ফ্রাউ রুবেন তাকে বললেন, আপনি শান্ত হোন। বারন ফন্ ফাক্লেনডর্ফ যখন আপনাকে বিয়ে করার জন্য পায়ের তলায় বসেন, তখন এর প্রত্যাখ্যানে অপমান বোধ করছেন কেন?
ভেরা বসে পড়লেন।
আমি তখন দিগ্বিদিকশূন্য। অতিকষ্টে বললুম, আমাকে দুদিন সময় দিন। ফ্রাউ রুবেন্স কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ভেরা বাধা দিয়ে বললেন, ‘সেই ভালো। দু’জনাই উঠে দাঁড়ালেন। ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, ‘পরশুদিন পাঁচটায় তাহলে এখানে আবার দেখা হবে।
হ্যান্ডশেক না করেই দুজনা বেরিয়ে গেলেন। ফ্রাউ রুবেন্স কঁচা রেল লাইনের উপর বিরাট এঞ্জিনের মতো হেলেদুলে গেলেন, আর ভেরার চেয়ার ছেড়ে ওঠা আর চলে যাওয়ার ধরন দেখে মনে হল, যেন টব ছেড়ে রজনীগন্ধাটি হঠাৎ দুখানা পা বের করে ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সর্বাঙ্গে হিল্লোল, কিন্তু মাথাটি স্থির, নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো। যেন রাজপুত মেয়ে কলসী-মাথায় চলে গেল। ক্যোনিক কাফের
আন্তর্জাতিক খদ্দের-গোষ্ঠী সে-চলন মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখল।
লেডি-কিলার সরকার বলল, মাইরি চাচা, আপনার সৌন্দর্যবোধ আর কবিত্বশক্তি দুইই আছে। অমনতরো বিপাকের মধ্যিখানে আপনি সবকিছু লক্ষ্য করলেন!
চাচা বললেন, কবিত্বশক্তি না ষাঁড়ের গোবর! আমি লক্ষ্য করেছিলুম জ্বরের ঘোরে মানুষ যে রকম শেতলপাটির ফুলের পেটার্ন মুখস্থ করে, সেই রকম।
তারপরে দুদিন আমার কী করে কেটেছিল সে-কথা আর বুঝিয়ে বলতে পারব না! একরকম হাবা হয় দেখেছিস, মুখে যা দেওয়া গেল তাই পড়ে পড়ে চিবোয় আর চিবোয়—বলে দিলেও গিলতে পারে না। আমি ঠিক তেমনি দুদিন ধরে একটি কথার দুটো দিক মনে মনে কত লক্ষবার যে চিবিয়েছিলুম বলতে পারব না। হিম্মৎ সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবার একমাত্র পন্থা যদি ফ্রলাইন ভেরাকে বিয়ে করাই হয় তবে আমি সে কর্তব্য এড়াই কী করে—আর চেনা নেই, পরিচয় নেই, একটা মেয়েকে হুশ করে বিয়ে করিই বা কী প্রকারে? সমস্যাটা চিবুচ্ছি আর চিবুচ্ছি, গিলে ফেলে ভালো-মন্দ যাই হোক, একটা সমাধান যে করব, সে ক্ষমতা যেন সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলুম।
মুরুব্বি নেই, বন্ধু নেই, সলা-পরামর্শ করিই বা কার সঙ্গে? হিম্মৎ সিং যাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা জন্মাবার কথা নয়, নিজের থেকেও কোনো বন্ধু জোটাতে পারিনি কারণ আমার জর্মন তখনো গল্প জমাবার মতো মিশ্রির দানা বাঁধেনি। যাই কোথায়, করি কী?
য়ুনিভার্সিটির কাছে একটা দুধের দোকানে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি—আমার মেয়াদের তখন আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা বাকি—এমন সময় জুতোর শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, সামনে ফ্রলাইন ক্লারা ফন্ ব্রাভেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের ছাত্রী, বার্লিনের মেয়েদের হকি টিমের কাপ্তান। ছ’ফুটের মত লম্বা, হঠাৎ রাস্তায় দেখলে মনে হতো মাইকেলএঞ্জেলোর মার্বেল মূর্তি স্কার্ট-ব্লাউজ পরে বেড়াতে বেরিয়েছে। আমার সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল।
জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে আপনার?
মাথা নাড়িয়ে জানালুম কিচ্ছু হয়নি।
ধমক দিয়ে বললেন, আলবৎ হয়েছে! খুলে বলুন।
বয়সে আমার চেয়ে ছয় বছরের বড় হয় কি না হয়, কথার রকম দেখে মনে হয় যেন জ্যাঠাইমা। বললুম, বলছি, কিছুই হয়নি।
ফন্ ব্ৰাখেল আমার পাশে বসলেন। আমার কোটের আস্তিনে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, বলুনই না কী হয়েছে।
তখন চেখফের একটা গল্প মনে পড়ল। এক বুড়ো গাড়োয়ান তার ছেলে মরে যাওয়ার দুঃখের কাহিনী কাউকে বলতে না পেয়ে শেষটায় নিজের ঘোড়াকে বলেছিল। ঘোড়ার সঙ্গে ফন্ ব্রাভেলের অন্তত একটা মিল ছিল। হকিতে তার ছুট যেমন-তেমন ঘোড়ার চেয়ে কম ছিল না। আমি তখন মরিয়া। ভাবলুম, দুগগা বলে ঝুলে পড়ি।
সমস্ত কাহিনী শুনে ফন্ ব্রাভেল পাঁচটি মিনিট ধরে ঠা-ঠা করে হাসলেন। হাসির ফাঁকে ফাঁকে কখনো বলেন, ‘ডু লীবার হের গট (হে মা কালী), কখনো বলেন, ‘ভী ক্যোলি’ (কী মজার ব্যাপার), কখনো বলেন, লাখেন ডি গ্যোটা’ (দেবতারা শুনলে হাসবেন)।