হিম্মৎ সিংয়ের ছবি দেখতে পাইনি, কিন্তু ভেরার চোখ থেকে বুঝতে পারলুম, হিম্মৎ সিং আমার জীবনের কতখানি জায়গা দখল করে বসে আছেন সে-কথা ভেরাও জানেন। তার চোখে আমার জন্য সহানুভূতি টলটল করছিল।
ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, আপনি হিম্মৎ সিংকে অত্যন্ত ভালোবাসেন।
এর উত্তর দেবার আমি প্রয়োজন বোধ করলুম না।
ফ্রাউ রুবেন তখন বললেন, একটি বিশেষ অনুরোধ করার জন্য আমরা দুজন আজ আপনাকে ডেকেছি। হিম্মৎ সিং আজ বার্লিনে নেই—যেখানেই হোন ভগবান তাকে কুশলে রাখুন—আমি ধরে নিচ্ছি তিনি যেন এখন আমাদের মাঝখানেই বসে আছেন। তাই আপনাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করছি, আজ যদি হিম্মৎ সিংয়ের কোনো প্রিয় কাজ করতে আপনাকে অনুরোধ করি আপনি সেটা করবার চেষ্টা করবেন কি?
আমি বললুম, আপনাদের মনে কি সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আছে?
ফ্রাউ রুবেন্স তখন বললেন, ‘আমার মনে নেই! ফ্রলাইন ভেরার জন্য শুধু আপনাকে জিজ্ঞাসা করছিলুম। ভেরা মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন, তারও কোনো প্রয়োজন ছিল না। ফ্রাউ রুবেন্স বললেন; ‘ভেরা অত্যন্ত বিপদে পড়ে মস্কো থেকে বার্লিন পালিয়ে এসেছেন। রাজনৈতিক দলাদলিতে ধরা পড়ে তার বাপ-মা, দু’ভাই সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হয়েছেন। এক ভাই তখন অডেসায় ছিলেন। তিনি কোনোগতিকে প্যারিসে পৌঁচেছেন। ভেরা যদি তার ভায়ের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন, তবে তার বিপদের শেষ হয়। কিন্তু তার কাছে রাশান পাসপোর্ট তো নেইই, অন্য কোনো পাসপোর্টও তিনি যোগাড় করতে পারেননি। জর্মন পাসপোর্ট পেলেও কোনো বিশেষ লাভ নেই। কারণ জর্মনদের ফ্রান্সে ঢুকতে দিচ্ছে না। তবে সেটা যোগাড় করতে পারলে তিনি অন্তত কিছুদিন বার্লিনে থাকতে পারতেন। এখন অবস্থা এই যে বার্লিন পুলিশ খবর পেলে ভেরাকে জেলে পুরবে। রাশাতেও ফেরৎ পাঠাতে পারে।
আমরা সবাই একসঙ্গে আঁৎকে উঠলুম।
চাচা বললেন, এতদিন পরও ঘটনাটা শুনে তোরা আঁৎকে উঠছিস। আমি শুনেছিলুম ফ্রলাইন ভেরার সামনাসামনি। আমার অবস্থাটা ভেবে দেখ।
ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, এখন কী করা যায় বলুন?
হিম্মৎ সিংয়ের কথা মনে পড়ল। আমাদের কাছে যে বাধা হিমালয়ের মতো উঁচু হয়ে দেখা দিয়েছে, তিনি তার উপর দিয়ে স্কেটিং করে চলে যেতেন। পাসপোর্ট যোগাড় করার চেয়ে দেশলাই কেনা তার পক্ষে কঠিন ছিল–শিখধর্মের সিগরেট নিষেধ’ তিনি মানতেন।
ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, ‘ভেরার জন্য পাসপোর্ট যোগাড় করা তাঁর পক্ষেও কঠিন, হয়তো অসম্ভব হত। কিন্তু একথাও জানি যে শেষ পর্যন্ত তিনি একটা পথ বের করতেনই করতেন।
এ বিষয়ে আমার মনেও কোনো সন্দেহ ছিল না।
ফ্রাউ রুবেন্স অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ফ্রলাইন ভেরাকে বিয়ে করতে আপনার কোনো আপত্তি আছে কি?
ধর্মত বলছি, আমি ভাবলুম ফ্রাউ রুবেন্স রসিকতা করছেন। সব দেশেরই আপন আপন বিদঘুটে রসিকতা থাকে, তাই এক ভাষার রসিকতা অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। হয়ত জর্মন রসিকতাটির ঠিক রস ধরতে পারিনি ভেবে ক্যাবলার মতো আমি তখন একটুখানি ‘হে-হে’ করেছিলুম।
ফ্রাউ রুবেন্স আমার কাষ্ঠরসময় ‘হে-হে’তে বিচলিত না হয়ে বললেন, ‘নিতান্ত দলিল-সংক্রান্ত বিয়ে। আপনি যদি ফ্রলাইন ভেরাকে বিয়ে করেন তবে তিনি সঙ্গেসঙ্গেই ভারতীয় অর্থাৎ ব্রিটিশ নেশনালিটি পেয়ে যাবেন এবং অনায়াসে প্যারিস যেতে পারবেন। মাসতিনেক পর আপনি ভেরার বিরুদ্ধে ডেজারশনের (পতিবর্জনের) মোকদ্দমা এনে ডিভোর্স (তালাক) পেয়ে যাবেন। তারপর একটু কেশে বললেন, ‘আপনাকে স্বামীর কোনো কর্তব্যই সমাধা করতে হবে না। একটুখানি থেমে বললেন, ‘খাওয়ানো পরানো, কিছুই না।’
লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে গিয়েছিল, না ভয়ে আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, না আশ্চর্য হয়ে আমার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছিল আজ এতদিন বাদে বলতে পারব না। এমনকি ক্যাবলাকান্তের মতো ‘হে-হে’ করাও তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
রায়ের বিয়ার ফুরিয়ে গিয়েছে বলে কথা বলার ফুর্সৎ পেলেন। বললেন, ‘বিলক্ষণ। আমারও সেই অবস্থা হয়েছে।
চাচা বললেন, ছাই হয়েছে, হাতি হয়েছে। আমার বিপদের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। সব কথা পয়লা শুনে নাও, তারপর যা খুশি বলল।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফ্রাউ রুবেন্স যা বললেন তার থেকে বুঝতে পারলুম যে তিনি ভাত ঠাণ্ডা হতে দেন না, তার উপরই গরম ঘি ছাড়েন। বললেন, আমার দৃঢ় প্রত্যয়, হিম্মৎ সিংকে এ পথটা দেখিয়ে দিতে হত না। তিনি দু’মিনিটের ভিতর সব কিছু ফিক্স উন্ড ফের্তিস (পাকাপোক্ত করে দিতেন।
চাচা বললেন, ইয়োরোপে cold-blooded খুন হয়, ভারতবর্ষে কোল্ড-ব্লাডেড বিয়ে হয়। এবং দুটোই ভেবে চিন্তে, প্ল্যানমাফিক, প্রিমেডিটেটেড। কিন্তু এখানে আমাকে অনুরোধ করা হচ্ছিল কোল্ড-ব্লাডেড বিয়ে করতে, কিন্তু না ভেবে-চিন্তে, অর্থাৎ রোমান্টিক কায়দায়। প্রথম দর্শনে প্রেম হয় শুনেছি, কিন্তু প্রথম দর্শনেই বিয়ে, এরকমধারা ব্যাপার আমি ইয়োরোপে দেখিওনি, শুনিওনি। অবশ্য আমার এ সব তাবৎ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু বলির পাঁঠা আমি হতে যাব কেন?
অপরূপ সুন্দরী। দেখে চিত্তচাঞ্চল্য হয়েছিল অস্বীকার করব না, কিন্তু বিয়ে–!
ফ্রাউ রুবেন্স গম্ভীরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
আমি চুপ।
তখন ফ্রাউ রুবেন্স এমন একখানা অস্ত্র ছাড়লেন যাতে আমার আর কোনো পথ খোলা রইল না। বললেন, আপনি কি সত্যি হিম্মৎ সিংকে ভালোবাসতেন?