বাইরে এসে শুধু বললেন, অব ইনলোগোঁকো পতা চ গিয়া কি হিন্দুস্থানী শরাব ভী পি সত্তা।
তারপর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে একখানা চেয়ারে বসালেন। নিজে খাটে শুলেন। কান পেতে আমার দুঃখ-বেদনার কাহিনী শুনলেন। তারপর বাড়ির কর্তী ফ্রাউ (মিসেস) রুবেসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মহিলাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিধবা। খানদানী ঘরের মেয়ে এবং হিম্মৎ সিংয়ের সঙ্গে যে ভাবে কথা কইলেন তার থেকে বুঝলুম যে হিম্মৎ সিং সে বাড়িতে রাজপুত্রের খাতির-যত্ন পাচ্ছেন।
তারপর এক মাসের ভিতর তিনি বার্লিন শহরের কত সব হোমরাচোমরা পরিবারের সঙ্গে আমায় আলাপ করিয়ে দিলেন, এতদিন পর সেসব পরিবারের বেশির ভাগের নামও আমার মনে নেই। কুটনৈতিক সমাজ, খানদানী গোষ্ঠী, অধ্যাপক মণ্ডলী, ফৌজী আজ্ঞা সর্বত্রই হিম্মৎ সিংয়ের অবাধ গতায়াত ছিল। হিম্মৎ সিং এককালে ভারতীয় ফৌজের বড়দরের অফিসার ছিলেন। ১৯১৪-১৮র যুদ্ধে বন্দী হয়ে জর্মনিতে থাকার সময় তিনি জর্মনদের যুদ্ধপরামর্শদাতা ছিলেন। এবং সেই সূত্রে বার্লিনের সকল সমাজের দ্বার তার জন্য খুলে যায়। হিম্মৎ সিং আমাকে কখনো তার জীবনী সবিস্তারে বলেননি, কাজেই জনরা কেন যে ১৯১৭-১৮ সালে তাকে মস্কো যেতে দিয়েছিল, ঠিক জানিনে। সেখান থেকে কেন যে আবার ১৯১৯ সালে বার্লিন ফিরে এলেন, তাও জানিনে। তবে তাকে বহুবার রুশ-পলাতক হোমরাচোমরাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে দেখেছি। সেসব রুশদের কাছ থেকে একথাও শুনেছি যে হিম্মৎ সিং মস্কোতে যে খাতির-যত্ন পেয়েছিলেন তার সঙ্গে তাঁর বার্লিনের প্রতিপত্তিরও তুলনা হয় না। কম্যুনিস্ট বড়কর্তাদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়াতে তিনি নাকি মস্কো ত্যাগ করেন। আশ্চর্য নয়, কারণ হিম্মৎ সিংয়ের মতো জেদী আর একরোখা লোক আমি আমার জীবনে দুটি দেখিনি।
আর আমায় লাই যা দিয়েছিলেন! ভালোমন্দ কিছুমাত্র বিবেচনা না করে আমাকে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যেতেন, আমি বেজার হয়ে বসে রইলে রাইস্টাক ভাড়া করে নাচের বন্দোবস্ত করবার তালে লেগে যেতেন। আমার সর্দি হলে বার্লিন মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালকে ডেকে পাঠাতেন, শরীর ভালো থাকলে নিজের হাতে কাবাবরুটি বানিয়ে খাওয়াতেন।
তিন মাস ধরে কেউ কখনো সুখ-স্বপ্ন দেখেছে? ফ্রয়েড নাকি বলেন, স্বপ্নের পরমায়ু মাত্র দু-তিন মিনিট। এ তত্ত্বটা জেনেও মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারলুম না, যেদিন হিম্মৎ সিং হঠাৎ কিছু না বলেকয়ে নিরুদ্দেশ হলেন। ফ্রাউ রুবেন্সও কিছুই জানেন না। বললেন, যে স্যুট পরে বেরিয়েছিলেন তাই নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। কয়েকদিন পরে মার্সাই থেকে চিঠি, তার জিনিসপত্র ভিখিরি-আতুরকে বিলিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে।
বহু বৎসর পরে জানতে পেরেছিলুম, আনহাটার স্টেশনে তার এক প্রাচীন রাজনৈতিক দুশমনকে হঠাৎ আবিষ্কার করতে পেয়ে তাকে ধরবার জন্য পিছু নিয়ে তিনি একবস্ত্রে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।
হিম্মৎ সিংয়ের সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি। তার কাছ থেকে কোন দিন কোনো চিঠিও পাইনি।
তারপর আরো তিন মাস কেটে গিয়েছে। বার্লিনে যে সমাজে আমাকে চড়িয়ে দিয়ে হিম্মৎ সিং মই নিয়ে চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকে আমি লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে জখমও হলুম।
এমন সময় ফ্রাউ রুবেন্স একদিন টেলিফোন করে অনুরোধ জানালেন আমি যেন তার সঙ্গে ক্যোনিক কাফেতে বেলা পাঁচটায় দেখা করি। বিশেষ প্রয়োজন। হিম্মৎ সিং চলে যাওয়ার পর ফ্রাউ রুবেসের সঙ্গে আমার মাত্র একদিন দেখা হয়েছিল। টেলিফোনে মাঝে মাঝে হিম্মৎ সিংয়ের খবর নিয়েছি—যদিও জানতুম তাতে কোনো ফল হবে না কিন্তু ও-বাড়িতে যাবার মত মনের জোর আমার ছিল না। গোঁসাইয়ের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বার্লিনে শরৎ চাটুয্যের উপন্যাস পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতুম না বটে, কিন্তু বাঙালি তো বটি!
পাঁচটার সময় কাফে ক্যোনিকে গিয়ে দেখি কাফের গভীরতম আর নির্জনতম কোণে ফ্রাউ রুবেন্স বসে, আর তার পাশে—এক ঝলকে যা দেখতে পেলুম—এক বিপজ্জনক সুন্দরী।
ফ্রাউ রুবেন্স পরিচয় দিয়ে নাম বললেন, ফ্রলাইন ভেরা গিব্রিয়ডফ।
লেডি-কিলার অর্থাৎ নটবর পুলিন সরকার জিজ্ঞেস করল, ‘বিপজ্জনক সুন্দরী বলতে কী বোঝাতে চাইলেন আমার ঠিক অনুমান হল না। বার্লিনের আর পাঁচজনের জন্য বিপজ্জনক, না আপনার নিজের ধর্মরক্ষায় বিপজ্জনক?
চাচা বললেন, আমার এবং আর পাঁচজনের জন্য বিপজ্জনক। তোর কথা বলতে পারিনে। তুই তো বার্লিনের সব বিপদ, সব ভয় জয় করতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিল।
শ্রীধর মুখুয্যে আবৃত্তি করল–
মাইন হের্ৎস ইস্ট ভী আইন বীনেনহাউস
ডী মেডেল জি ডী বীনেন—
হৃদয় আমার মধুচক্রের সম
মেয়েগুলো যেন মৌমাছিদের মতো
কত আসে যায় কে রাখে হিসাব বল
ঠেকাতে, তাড়াতে মন মোর নয় রত।
রায় বললেন, কী মুশকিল! এরা যে আবার কবিত্ব আরম্ভ করল।
চাচা বললেন, ফ্রাউ রুবেন্স ফ্রলাইন ভেরার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বিশেষ করে জোর দিয়ে বললেন যে হিম্মৎ সিং যখন মস্কোতে ছিলেন তখন বসবাস করেছিলেন গিব্রিয়ডফদের সঙ্গে। আমি তখন ভেরার দিকে তাকাতে তিনিও ভালো করে তাকালেন।
ছ’মাস ধরে প্রতিদিন যে লোকটির কথা উঠতে-বসতে মনে পড়েছে তিনি এদের বাড়িতে ছিলেন, এই মেয়েটির চোখে তার ছায়া কত শত বার পড়েছে, আমি আমার অজান্তে তার চোখে যেন হিম্মৎ সিংয়ের ছবি দেখতে পাবার আশা করে ভালো করে তাকালুম।