চাচা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার অ্যাবনর্মাল অবস্থাটা দেখবার বাসনা আমার মাঝে মাঝে হয়।’
রায় আঁৎকে উঠে বললেন, ষাট, ষাট! আমি মরব, আপনিও মরবেন। গেল সাত বছরে একদিন এক ঘন্টার তরে বিয়ার না খেয়ে আমি অ্যাবনর্মাল অবস্থায় ছিলুম। গিয়েছিলুম ফেরবেল্লিনার প্লাৎসের মসজিদে—ঈদের পরবে।* মদ খেয়ে মসজিদে যাওয়ার সাহস ওমর খাইয়ামেরও ছিল না, আমি তো নস্যি। বলে ওস্তাদরা যে রকম মিয়া (তানসেন) কী তোড়ী গাইবার সময় কানে হাত ছোঁয়ান সেইরকম কানমলা খেয়ে নিলেন। বললেন, ফল? ফেরার পথে মিস জমিতফকে বিয়ের কথা দিয়ে ফেলেছি। অ্যাবনর্মাল–
কিন্তু তারপর রায় কী বলেছিলেন, সে কথা শোনে কে? রায়ের পক্ষে খুন করা অসম্ভব নয়, অবস্থাভেদে গাঁটও হয়তো তিনি কাটতে পারেন, কিন্তু তিনি যে একদিন বিয়ের ফাঁদে পা দেবেন, এত বড় অসম্ভব অবস্থার কল্পনা আমরা কোনো দিন করতে পারিনি। স্বয়ং হিন্ডেনবুর্গ যদি তখন গোঁফ কামিয়ে আমাদের আড্ডায় এসে উপস্থিত হতেন তাহলেও আমরা এতদূর আশ্চর্য হতুম না।
রায় তখন লড়াইয়ে-জেতা বীরের গর্জনে হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, দেখতে চান আমার অ্যাবনর্মাল অবস্থা আরো দু-চারবার? সরকারী লাইব্রেরী পোড়ানো, আইনস্টাইনকে খুন, কিছুই বাদ যাবে না। তবু যদি
চাচা বললেন, বড় ভাবিয়ে তুললে হে রায়সাহেব!
আমরা তখন সবাই কলরব করে রায়কে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেউ বলছে এমন সুন্দরী সহজে জোটে না, কেউ বলছে, ম্যাথম্যাটিকস যা জানে, কেউ বা বলে, কী মিষ্টি স্বভাব!
সরকার বলল, ওহে গোলাম মৌলা, রাধা কেষ্টর কে হয় জানো?
চাচা বললেন, বড় ভাবিয়ে তুললে হে রায়সাহেব!
দু-দুবার চাচা যে কেন ‘ভাবিত’ হলেন আমরা ঠিক ধরতে পারলুম না। রায় যে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে আশ্চর্য হওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কী আছে?
চাচার সবচেয়ে ন্যাওটা ভক্ত গোঁসাই বলল, আপনি তো বিয়ে করেননি, কখনো এনগেজডও হননি। তাই আপনার ভয়, ভাবনা
চাচা বললেন, আমার ফাঁসি হয়নি সত্যি, কিন্তু তাই বলে আসামী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াইনি, তুই কী করে জানলি?’
ঠেলাঠেলির ভিতর বাসের হ্যান্ডেল ধরতে পেলে মানুষ যে রকম ঝুলে পড়ে, রায় ঠিক তেমনি চাচার জবানবন্দীর হ্যান্ডেল পেয়ে বললেন, ‘উকিলের নাম বলুন চাচা, যে আপনায় বাঁচালে।
রায়ের বিয়ের খবর শুনে আমরা আশ্চর্য হয়েছিলুম, কিন্তু স্তম্ভিত হইনি। কারণ রায় স্ত্রীজাতিকে অতি সন্তর্পণে দূরে ঠেলে রাখতেন। তাই শেষ পর্যন্ত ধরা দিলেন। কিন্তু চাচা এ সব বাবদে স্ত্রী-পুরুষে কোনো তফাৎ রাখতেন না। বার্লিনের মেয়েমহলে তিনি ছিলেন বেসরকারী পাত্রী। বরঞ্চ পাদ্রীদের সম্বন্ধে ফষ্টিনষ্টির কাহিনী মাঝে মাঝে শোনা যায়, কিন্তু চাচার হৃদয় জয় করতে যাবে কে? সে-হৃদয় তিনি বহু পূর্বেই আত্মজনের মাঝে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। অততা হিস্যেদারের সম্পত্তি নিলামে উঠলেও তো কেউ কেনে না। আমরা সবাই করুণ নয়নে চাচার দিকে তাকালুম, তিনি যেন কাহিনীটা চেপে না যান।
চাচা বললেন, ‘ওরকম ধারা তাকাচ্ছিস কেন? তোরা কাউকে চিনবিনে। ১৯১৯-এর কথা। আমি তখন সবে বার্লিনে এসেছি। বয়স আঠারো পেয়নি। মাকুন্দ বলে বিনা ব্লেডে গোঁফ কামাতুম—ল্যান্ডলেডি যাতে ঘর গোছাবার সময় ক্ষেউরির জিনিসপত্র না দেখে ভাবে আমি নিতান্ত চ্যাংড়া। তার থেকেই বুঝতে পারছিস আমি কতটা অজ পাড়াগেঁয়ে, আনাড়ি ছিলুম। একগাদা ভারতীয়ও ছিল না যে আমাকে সলা-পরামর্শ দিয়ে ওয়াকিফহাল করে তুলবে। যে দু-চারজন ছিলেন তারা তখন আপন আপন ধান্দায় মশগুল—জর্মনির তখন বড় দুর্দিন।
ভাগ্যিস দু-চারটে গুঁত্তাগাঁত্তা খাওয়ার পরই হিম্মৎ সিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল!
সাইনবোর্ডে ‘গেট্রেক্তে’ (পানীয়) শব্দ দেখে আমি বিয়ারখানায় ঢুকে দুধ চেয়ে বসেছি। কী করে জানবো বল পানীয়গুলো রূঢ়ার্থে বিয়ার-ব্রান্ডি বোঝায়। ওয়েট্রেসগুলো পাজরে হাত দিয়ে দু-ভাজ হয়ে এমনি খিলখিল করে হাসছিল যে শব্দ শুনে হিম্মৎ সিং রাস্তা থেকে তাড়িখানার ভিতরে তাকালেন। আমার চেহারা দেখে তার দয়ার উদয় হয়েছিল তোদের মতো পাষণ্ডগুলোরও হত। গটগট করে ঘরে ঢুকলেন। আমার পাশে বসে ওয়েট্রেসকে বললেন, ‘এক লিটার বিয়ার বিটে (প্লীজ)!
আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ার নহী পিতে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললুম, না।
‘ওয়াইন?
ফের মাথা নাড়ালুম।।
‘কিসি কিসকি শরাব?’
আমি বললুম যে আমি দুধের অর্ডার দিয়েছি।
দাড়ি-গোঁপের ভিতর যেন সামান্য একটু হাসির আভাস দেখতে পেলুম। বললেন, ‘অ সমঝা। তারপর আমাকে বসে থাকতে আদেশ দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন এক গেলাস দুধ হাতে নিয়ে। সমস্ত বিয়ারখানার লোক যে অবাক হয়ে তার কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছে, সেদিকে কণামাত্র হৃক্ষেপ নেই। তারপর, সেই যে কসলেন গেট হয়ে, আর আরম্ভ করলেন জালা জালা বিয়ার-পান। সে পান দেখলে গোলাম মৌলা আর ককখনো রায়ের পানকে ভয় করবে না।
শিখের বাচ্চা, রক্তে তার তিনপুরুষ ধরে আগুন-মার্কা ধেননা, আর মোলায়েমের মধ্যে নির্জলা হুইস্কি। বিয়ার তাঁর কী করতে পারে?
লিটার আষ্টেক খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পয়সা দিয়ে বেরোবার সময়ও কোনো দিকে একবারের তরে তাকালেন না। আমি কিন্তু বুঝলুম, বিয়ারখানার হাসি ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। সবাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে হিম্মৎ সিংয়ের দিকে তাকাচ্ছে, আর ফিসফিস প্রশংসাধ্বনি বেরুচ্ছে।