খাওয়ার শেষের দিকে যখন আমি প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি যে, ডুটেন্হফারদের জিভে হয় ফোস্কা নয় বাত, তখন হের ওবের্স্ট হঠাৎ পরিষ্কার ইংরিজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শেক্সপীয়ারের কোন নাট্য আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?
আমার পড়া ছিল কুল্লে একখানাই। নির্ভয়ে বললুম, হ্যামলেট।
‘গ্যেটে পড়েছেন?
আমি বললুম, অতি অল্প।
‘একসঙ্গে গ্যেটে পড়ব?’
আমি আনন্দের সঙ্গে, অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে সম্মতি জানালুম। মনে মনে বললুম, ‘দেখাই যাক না প্রাশান রাজপুত কী রকম কালিদাস পড়ায়। হের ওবের্স্টের চেহারাটি যদিও ভাবুকের মতো, তবু কুলোপানা চক্কর হলেই তো আর দাঁতে কালবিষ থাকে না।
ফ্রাউ ডুটেন্হফার বললেন, ‘ভদ্রলোক জর্মন বলতে পারেন।
তাই নাকি?’ বলে সেই যে ইংরিজি বলা বন্ধ করলেন তারপর আমি আর কখনন তাকে ইংরিজি বলতে শুনিনি।
লাঞ্চ শেষ হতেই হের ওবের্স্ট উঠে দাঁড়ালেন। জুতোর হিলে হিলে ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে স্ত্রীকে, তারপর আমাকে বাও’ করে আপন ঘরের দিকে চলে গেলেন। বাপের বয়সী লোক, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এরকম ‘বাও’ করে বসবে কী করে জানব বললা! আমি হন্তদন্ত হয়ে উঠে বার বার ‘বাও’ করে তার খেসারতি দেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু মনে মনে মাদামের সামনে বড় লজ্জা পেলুম। পাছে তিনিও আবার কোনো একটা নতুন এটিকেট চালান সেই ভয়ে—যদিও আমার কোনো তাড়া ছিল না। আমি দু’মিনিট যেতে না যেতেই উঠে দাঁড়ালুম, মাদামকে কোমরে দু’ভাজ হয়ে ‘বাও’ করে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলুম-হিলে হিলে ক্লিকটা আর করলুম না, জুতোর হিল রবরের ছিল বলে।
চারটের সময় কফি খেতে এসে দেখি হের ওবের্স্ট নেই। মাদাম বললেন, তিনি অপরাহে আর কিছু খান না। মনে মনে বললুম, বাব্বা, ইনি পওহারী বাবার কাছে পৌঁছে যাবার তালে আছেন!
ডিনারে ওবের্স্ট খেলেন তিন খানা সেনউইজ আর এক কাপ চা—তাও আর পাঁচজন জর্মনের মতো—বিনদুধে।
চাচা থামলেন। তারপর গুনগুন করে অনুষ্টুপ ধরলেন
‘এবমুক্তো হৃষিকেশো গুড়াকেশেন ভারত।’
তারপর বললেন, আমি গুড়াকেশ নই, নিদ্রা আমি জয় করিনি। নিদ্রাই আমাকে জয় করেছেন, অর্থাৎ আমি ইনসমনিয়ায় কাতর। কাজেই সংযমী না হয়েও যা নিশা সর্বভূতানাং তার বেশির ভাগ আমি জেগে কাটাই। রাত তিনটের সময় শুতে যাবার আগে জানলার কাছে গিয়ে দেখি কর্তার পড়ার ঘরে তখনো আলো জ্বলছে।
দেরিতে উঠি। ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে দেখি কর্তার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। লজ্জা পেলুম, কিন্তু সেটা পুষিয়ে নিলুম লোহার নালে নালে এমনি বমশেল ক্লিক করে যে, মাদাম আঁৎকে উঠলেন। মনে মনে বললুম, হিন্দুস্থানীকি তমিজ ভী দেখ লিজিয়ে!
ওবের্স্টকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘আপনি কি অনিদ্রায় ভোগেন?’ বললেন, ‘না তো।’ আমি কেন প্রশ্নটা শুধালুম সে সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল না দেখিয়ে শুধু স্মরণ করিয়ে দিলেন যে দশটায় গ্যেটে-পাঠ।
পূর্ণ এক বৎসর তিনি আমায় গ্যেটে পড়িয়েছিলেন, দুটি শর্ত প্রথম দিনই আমার কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে। তিনি কোনো পারিতোষিক নেবেন না, আর আমার পড়া তৈরি হোক আর না হোক, ক্লাস কামাই দিতে পারব না।
মিলিটারি কায়দায় লেখাপড়া শেখা কাকে বলে জানো? বুঝিয়ে বলছি। আমরা দেশকালপাত্রে বিশ্বাস করি। গুরুর যদি শরীর অসুস্থ থাকে, ছাত্রের যদি পিতৃশ্রাদ্ধ উপস্থিত হয়, পালা-পরবে যদি কোথাও যেতে হয়, পাঠ্যপুস্তকের যদি অনটন হয়, শিক্ষক অথবা ছাত্রের যদি পড়া তৈরি না থাকে, গুবীর যদি ঘৃতলবণতৈলতলবস্ত্রইন্ধন সংক্রান্ত কোনো বিশেষ প্রয়োজন হয় এবং তখনকার গম-বরাদ্দের (রেশনিঙের) দিনে তার নিত্য নিত্য প্রয়োজন হত—তাহলে অনধ্যায়। কিন্তু প্রাশান মিলিটারি-মার্গ অঘটনঘটনপটিয়সী দৈবদুর্বিপাকে বিশ্বাস করে না। আমি বুকে কফ নিয়ে এক ঘন্টা কেশেছি, ক্লাস কামাই যায়নি, হিন্ডেনবুর্গ হের ওবের্স্টকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, ক্লাস কামাই যায়নি। একটি বৎসর একটানা গ্যেটে, আবার গ্যেটে এবং পুনরপি গ্যেটে। তার অর্ধেক পরিশ্রমে পাণিনি কণ্ঠস্থ হয়, সিকি মেহন্নতে ফিরদৌসীকে ঘায়েল করা যায়।
অথচ পড়ানোর কায়দাটা ন’ সিকে ভটচার্যি। গ্যেটের খেই ধরে বাইমার, বাইমার থেকে রিঙে, ট্যুরিঙে থেকে পূর্ণ জনির ইতিহাস। গ্যেটের সঙ্গে বেটোফেনের দেখা হয়েছিল কার্লসবাডে—সেই খেই ধরে বেটোফেনের সঙ্গীত, বাগনারে তার পরিণতি, আমেরিকায় তার বিনাশ। গ্যেটে শেষ বয়সে সরকারি গেইমরাট খেতাব পেয়েছিলেন, সেই খেই ধরে জর্মনির তাবৎ খেতাব, তাবৎ মিলিটারি মেডেল, গণতন্ত্রে খেতাব তুলে দেওয়াটা ভালো না মন্দ সে সব বিচার, এককথায় জর্মন দৃষ্টিবিন্দু থেকে তামাম ইয়োরাপের সংস্কৃতি-সভ্যতার সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস। পূর্ণ এক বৎসর ধরে গ্যেটের গোষ্পদে ইয়োরাপের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়েওঠা ইতিহাস-ঐতিহ্য বিম্বিত হল।
আর এ সব কিছু ছাড়িয়ে যেত তার আবৃত্তি করার অদ্ভুত ইন্দ্রজাল। সে ইন্দ্রজালের মোহ বোধহয় আমার এখনো কাটেনি। আমি এখনো বিশ্বাস করি, মন্ত্র যদি ঠিক ঠিক উচ্চারণ করা যায়—যে-শ্রদ্ধা, যে-অনুভূতি, যে-সংজ্ঞা নিয়ে ডুটেনহার গ্যেটে আবৃত্তি করতেন—তাহলে ঈশিত ফললাভ হবেই হবে।
পূর্ণ এক বৎসর রোজ দু’ঘন্টা করে এই গুণীর সাহচর্য পেলুম, কিন্তু আশ্চর্য, তার নিজের জীবন অথবা তার পরিবার সম্বন্ধে তিনি কখনো একটি কথাও বলেননি। কেন তিনি মিলিটারি ছাড়লেন, লুডেন্ডর্যের আহ্বানে জর্মনিতে নূতন দল গড়াতে কেন তিনি সাড়া দিলেন না (কাগজে এ সম্বন্ধে জল্পনা কল্পনা হত), পেন্সন কেন তিনি ত্যাগ করলেন, না করে পারিবারিক তৈলাকন তৈজসপত্র বাঁচাননা কি অধিকতর কাম্য হত না,—এ-সব কথা বাদ দাও, একদিনের তরে ঠাট্টাচ্ছলেও তাকে বলতে শুনিনি, প্রথম যৌবনে তিনি সোয়া দু’বার না আড়াইবার প্রেমে পড়েছিলেন অথবা ছাত্রাবস্থায় মাতাল হয়ে ল্যাম্পপোস্টকে জড়িয়ে ধরে ‘ভাই, এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি’ বলে কান্নাকাটি করেছিলেন কি না।