এক সাধুর কৃপায় আমি সুস্থ হয়ে উঠলুম। কিন্তু অকালে বৃষ্টি নামলে আমাকে এখনো বোতল বোতল মদ খেয়ে ছবিটা মগজ থেকে মুছে ফেলতে হয়।
স্বয়ংবরা
বার্লিনের বড় রাস্তা কুরফুর্স্টেনডাম যেখানে উলান্ডস্ট্রাসের সঙ্গে মিশেছে, সেখান থেকে উলান্ডস্ট্রাসে উজিয়ে দু-তিনখানা বাড়ি ছাড়ার পরই ‘Hindusthan Haus’ অর্থাৎ ‘Hindusthan House’ অর্থাৎ ভারতীয় ভবন’। আসলে রেস্তোরাঁ, দা-ঠাকুরের হোটেল বললেই ঠিক হয়। জর্মনি শুয়োরের দেশ, অর্থাৎ জর্মনির প্রধান খাদ্য শূকর মাংস। হিন্দুস্থান হাউসে সে মাংসের প্রবেশ নিষেধ। সেই যে তার প্রধান গুণ তা নয়, তার আসল গুণ, সেখানে ভাত ডাল মাছ তরকারি মিষ্টি খেতে পাওয়া যায়। আর যেদিন ঢাকার ফণি গুপ্ত বা চাটগাঁর আব্দুল্লা মিয়া রসুইয়ের ভার নিতেন সেদিন আমাদের পোয়াবারো, কিন্তু উলাডস্ট্রাসেতে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে যেত। জর্মনিতে লাল লঙ্কার রেওয়াজ নেই, (‘পাপ্রিকা’ নামক যে লাল আবীর লঙ্কার পদ পেতে চায় তার স্বাদ আবীরেরই মতো) কাজেই হিন্দুস্থান হৌসে লঙ্কা-ফোড়ন চড়লে তার চতুর্দিকে সিকি মাইল জুড়ে হাঁচি-কাশি ঘন্টাখানেক ধরে চলত। পাড়াপড়শীরা নাকি দু-চারবার পুলিশে খবর দিয়েছিল, কিন্তু জর্মন পুলিশ তদারক-তদন্ত করতে হলে খবর দিয়ে আসত বলে আমরা সেদিনকার মতো লঙ্কার হাঁড়িটা ‘ডয়েটশে ব্যাঙ্কে’ জমা দিয়ে আসতুম। শুনেছি শেষটায় নাকি প্রতিবেশীদের কেউ কেউ লঙ্কা-ফোড়ন চড়লে গ্যাস-মাস্ক পরত। জর্মনি বৈজ্ঞানিকদের দেশ।
ঢুকেই রেস্তোরাঁ। গোটা আষ্টেক ছোট ছোট টেবিল। এক একটা টেবিলে চারজন লোক খেতে পারে। একপাশে লম্বা কাউন্টার, তার পিছনে হয় ফণি নয় আব্দুল্লা লটরটর করত, অর্থাৎ অচেনা খদ্দের ঢুকলে তার সামনে ব্যস্ত-সমস্ততার ভান করত। কাউন্টারের পাশ দিয়ে ঢুকে পিছনে রান্নাঘর। রেস্তোরাঁর যে দিকে কাউন্টার তার আড়াআড়ি ঘরের অন্য কোণে কয়েকখানা আরামকেদারা আর চৌকি কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। এ কুণ্ডলীর চক্রবর্তী চাচা, উজির-নাজির গুটি ছয় বাঙালি।
অবাঙালিরা আমাদের আড্ডায় সাধারণত যোগ দিত না। তার জন্য দায়ী চাচা। তিনি কথা বলতেন বাঙলায়, আর অবাঙালি থাকলে জর্মনে। এবং সে এমনি তুখোড় জর্মন যে তার রস উপভোগ করবার মতো ক্ষমতা খুব কম ভারতীয়েরই ছিল। ফলে অবাঙালিরা দুদিনের ভিতরই ছিটকে পড়ত। বাঙালিরা জানত যে তারা খসে পড়লেই চাচা ফের বাঙলায় ফিরে আসবেন। তাই তারা তার কটমটে জর্মন দুদণ্ডের মতো বরদাস্ত করে নিত।।
জব্বলপুরের ঔপনিবেশিক বাঙালি শ্রীধর মুখুয্যে তাই নিয়ে একদিন ফরিয়াদ করে বলেছিল, বাঙালি বড্ড বেশি প্রাদেশিক। আর পাঁচজন ভারতবাসীর সঙ্গে মিলে-মিশে তারা ভারতীয় নেশন গড়ে তুলতে চায় না।
চাচা বলেছিলেন, প্রাদেশিক নয়, বাঙালি বড্ড বেশি নেশনাল। বাংলাদেশ প্রদেশ নয়, বাংলাদেশ দেশ। ভারতবর্ষের আর সব প্রদেশ সত্যকার প্রদেশ। তাদের এক-একজনের আয়তন, লোকসংখ্যা, সংস্কৃতি এত কম যে পাঁচটা প্রদেশের সঙ্গে জড়াজড়ি করে তারা যদি ইন্ডিয়ান নেশন, ইন্ডিয়ান নেশন’ বলে চেল্লাচেল্লি না করে, তবে দুনিয়ার সামনে তারা মুখ দেখাতে পারে না। এই বার্লিন শহরেই দেখ। আমরা জন চল্লিশ ভারতীয় এখানে আছি। তার অর্ধেকের বেশি বাঙালি। মারাঠি, গুজরাতি কটা, এক হাতের এক আঙুল, জোর দু আঙুলে গোনা যায়। ত্রিশটা লোক যদি বিদেশের কোনো জায়গায় বসবাস করে তবে অন্তত তার পাঁচটা একজায়গায় জড়ো হয়ে আড্ডা দেবে না? মারাঠি, গুজরাতিরা আড্ডা দেবার জন্য তোক পাবে কোথায়?
আড্ডার পয়লা নম্বরের আড্ডাবাজ পুলিন সরকার বলল, ‘লোক বেশি হলেও তারা আর যা করে করুক, আড্ডা দিতে পারত না। আড্ডা জমাবার বুনিয়াদ হচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপ, কাছারি-বাড়ি, টঙ্গিঘর, বৈঠকখানা—এককথায় জমিদারী প্রথা।
চাচা জিজ্ঞেস করলেন, তাই বুঝি তুই কলেজ পালিয়ে আড্ডা মারিস? তোদের জমিদারীর সদর-খাজনা কত রে?
সরকার বলল, কাণাকড়িও না। জমিদারি গেছে, আচ্ছাটি বাঁচিয়ে রেখেছি। আমার ঠাকুরদাকে এক সায়েব আদালতে জিজ্ঞেস করেছিল তার ব্যবসা কী? বুড়ো বলেছিল, সেলিং।
মুখুয্যে জিজ্ঞেস করল, তার মানে?
তার মানে, তিনি জমিদারী বিক্রি করে করে জীবনটা কাটিয়েছেন। তাই বাবাকে কোনো সদর-খাজনা দিতে হয়নি।
হিন্দুস্থান হৌসে মদ বিক্রি হত না। কিন্তু বিয়ার বারণ ছিল না। সূর্য রায় বেশির ভাগ সময়ই বিয়ারে গলা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে নাক দিয়ে ধুয়ো ছাড়তেন। চাচার পরেই জ্ঞানগম্যিতে তার প্রাধান্য আড্ডায় ছিল বেশি। চাচার জর্মনজ্ঞান ছিল পাণ্ডিত্যের জ্ঞান, আর রায়ের জ্ঞান ছিল বহুমুখী। বার্লিনের মতো শহরের বুকের উপর বসে তিনি কাগজে জন কলাম লিখে পয়সা কামাতেন। ফোনে কথা শুনে শব্দতাত্ত্বিক হের মেনজেরাট পর্যন্ত ধরতে পারেননি যে জর্মন রায়ের মাতৃভাষা নয়।
চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, ‘হক কথা কয়েছ সরকার। সবই বিক্রি, সব বেচে ফেলতে হয়। খাই তো দুফোঁটা বিয়ার, কিন্তু বিক্রি করে দিতে হয়েছে বেবাক লিভারখানা।’
আড্ডার সবচেয়ে চ্যাংড়া ছিল গোলাম মৌলা। রায়ের ‘প্রতেজে’ বা ‘দেশের ছেলে’। সে সবসময় ভয়ে ভয়ে মরত, পাছে রায় বিয়ারে বানচাল হয়ে যান। চুপেচুপে বলল, মামা, বাড়ি চলুন।
রায় চোখ মেললেন। একদম সাদা। বললেন, তুই বুঝি ভয় পেয়েছিস আমি মাতাল হয়ে গিয়েছি! ইম্ বিন্ ইন্ মাইনে নরমালে সুস্টান্ট, ডাস্ হাইস্ট, আইন বিশে ব্লউ। আমি আমার সাধারণ (নর্মাল) অবস্থায় আছি, অর্থাৎ ঈষৎ নীল। তার মানে, মনে একটু রঙ লেগেছে, এবং ঐ রঙ লাগানো অবস্থাই ছিল তার নর্মাল অবস্থা। মদ্যসংক্রান্ত বিষয় রায় কখনো বাংলায় বলতেন না। তার মতে বাংলায় তার কোনো পরিভাষা নেই। পান্তা ভাতে কাঁচা লঙ্কা চটকে এক সানকে গিলে এলুম—যেমন জনে বলা যায় না, তেমনি মদ্যসংক্রান্ত ব্লাউ (নীল), বেজফেন্ (টে-টঘুর), ফ (সম্পূর্ণ), বেঙ্কে (ডুবেমরা) কথার বাংলা করলেও বাংলা হয় না।