ভাগ্যিস, আমি ইস্কুল মাস্টার। আমার ছেলেরা ছুটলো এদিক-ওদিককার শহরে। তারা সব হিন্দু, দু-একটি মুসলমান, কিন্তু গুরুর দায় বুঝতে পেরে কেউ সাইকেলে চড়ে, কেউ লোকাল ধরে এমনি লাগা লাগলো যে মনে হল তারা বুঝি কুয়েশচেন পেপার লীক হওয়ার সন্ধান পেয়েছে। ভগবান তাদের মঙ্গল করুন, সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে গেল।
ছেলেদের বললুম, ‘বাবারা আমায় বাঁচালে। কিন্তু আর না। তোমাদের আর সঙ্গে আসতে হবে না। আর শোননা, এই গরমে যদি টাওয়ার যেতে-আসতে আমি মরি তাহলে আমাকে পুড়িয়ে ফেলল, না হয় গোর দিয়ো।
আমি বললুম, সে কী কথা!
আমার কথা যেন আদপেই শুনতে পাননি সেইরকম ভাবে বলে যেতে লাগলেন, ‘যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কড়াইয়ে গরম তেল ফুটছে আর আমি তারই ভিতর সাঁতার কেটে কেটে টাওয়ারের দিকে চলেছি। এক পা ফেলি আর ভাবি এ-দুনিয়ায় এই শেষ পা ফেলা, পরের কদমেই দেখব জাহান্নমের বুকিং আপিসের সামনে কিউয়ে পৌঁছে গিয়েছি স্বর্গে যাওয়ার হলে ভগবান এই কড়াই-ভাজার প্র্যাকটিস কপালে লিখবেন কেন?
টাওয়ার অফ সায়লেন্সের সামনে এসে বসে পড়েছি। দস্তুর’জীর শেষ মন্ত্রোচ্চারণ আমার কানে এসে পৌচ্ছে যেন কোন দূরদূরান্ত থেকে। বোঝা-না-বোঝার মাঝখান দিয়ে যেন কিছু দেখছি, কিছু শুনছি। শববাহকেরা ক্লান্ত শ্লথ গতিতে মড়া নিয়ে টাওয়ারের ভিতর ঢুকল।
তার পরমুহূর্তেই আমার সমস্ত চৈতন্য ফিরে এল, টাওয়ারের ভিতর থেকে এক সঙ্গে অনেকগুলো তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে। সে চিৎকারে ছিল মাত্র একটা জিনিস—ভয়! যারা চিৎকার করলো তারাই যে শুধু ভয় পেয়েছে তা নয়, সে চীৎকার যেন স্পষ্ট ভাষায় বললো, আর কারো নিস্তার নেই।
সঙ্গে সঙ্গে চারজন শববাহকের দুজন পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে এদিকওদিক টাল খেয়ে খেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল গেট দিয়ে। একজন আমাদের দিকে তাকিয়েই একমুখ ফেনা বমি করে পড়ল ‘দস্তুর’জীর পায়ের কাছে, আরেকজন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সেইরকম টাল খেয়ে খেয়ে যে কোন দিকে চলল সে জানে না। দস্তুর’জীও একবার তার দিকে তাকান আরেকবার তাকান ভিরমি-যাওয়া লোকটার দিকে। টাওয়ারের ভিতর থেকে আর কোনো শব্দ আসছে না, কিন্তু যে পাগলটা ছুটে চলেছে সে চিৎকার করে করে যেন গলা ফাটিয়ে দিচ্ছে-সে কী অমানুষিক বীভৎস কণ্ঠস্বরের বিকৃত পরিবর্তন।
‘দস্তুর’জী আর আমি এমনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি যে আমাদের মাথায় কর্তব্যাকর্তব্য কিছুই খেলছে না, পা দুটো যেন মাটিতে শেকড় গেড়ে বসে গিয়েছে। হতভম্ব হয়ে গিয়েছি বললে অল্পই বলা হল, কারণ অদ্ভুত এক ভীতি আমাকে তখন অসাড় করে ফেলেছে।
কতক্ষণ এ রকম ধারা কাটলো আমার মনে নেই। আস্তে আস্তে মাথা সাফ হতে লাগল, কিন্তু ভয় তখনো কাটেনি। দস্তুর’জী বললেন, ‘আর দুটো শববাহকের কী হল? তারা বেরচ্ছে না কেন? আমার মনেও সেই প্রশ্ন, উত্তর দেব কী?
‘দস্তুর’জী—আমার দুজনেরই ভিতরে যাওয়া বারণ। দস্তুর’জীর কর্তব্যবোধ হয়েছে না কি, কে জানে, বললেন, চলুন, ভিতরে যাই।
আমার এখনো মনে হয়, ‘দস্তুর’জী তখন সম্পূর্ণ সম্বিতে ছিলেন না। আমি জানি আমি নিশ্চয়ই ছিলুম না। তার পিছনে পিছনে কোন সাহসে ভর করে গেলুম বলতে পারব না। আমি এ-বিষয়ে বহু বৎসর ধরে আপন মনে তোলপাড় করেছি। খুব সম্ভব যুগ যুগ ধরে দস্তুর’জীদের হুকুম তামিল করে করে আমরা সাধারণ গৃহী বিপদকালে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এখনো তাদের অনুসরণ করি।
ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকে মোড় নিয়েই দেখি—
ভদ্রলোক হঠাৎ থেমে গেলেন। আমি বললুম, কী, কী?
আমার দিকে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে বললেন, এই যেরকম আমি আপনার দিকে তাকালুম, ঠিক সেইরকম তাকিয়ে আছে টাওয়ারের দেয়ালের একটা শেলফের ভিতর পা ছড়িয়ে বসে, ঘাড় আমাদের দিকে ফিরিয়ে সেই হাড্ডিসার বুড়ি যাকে আমরা তিন মাস আগে এই টাওয়ারে রেখে গিয়েছিলুম। গায়ের চামড়া আরো শুকিয়ে গিয়েছে, আরআর, চোখের কোটর দুটো ফাঁকা, কালো দুই গর্ত। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লুম।’ হুঙ্কার দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কেউ আমাকে একটা পোতল দেবে না, নাকি রে?’
অথবা ঐ রকম কিছু একটা। আমি স্পষ্ট শুনতে পাইনি। ভয়ে আমার সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে উঠেছে। কী করে যে এ রকম ব্যাপার সম্ভবপর হতে পারে সে কথা জিজ্ঞেস করবার মতো হিম্মৎ বুকে বেঁধে উঠতে পারছিনে, পাছে আরো ভয়ঙ্কর কোনো এক বিভীষিকা তিনি আমার চোখের সামনে তুলে ধরেন।
হঠাৎ যেন আমার প্রতি ভদ্রলোকের দয়া হল। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। আপনাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলছি।।
যখন জ্ঞান ফিরে পেলুম তখন দেখি আমার উপর কে যেন বালতি বালতি জল ঢালছে। তারপর বুঝলুম বৃষ্টি নেমেছে। আমার চতুর্দিকে স্কুলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সেই যে শববাহক পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল তাকে ও রকম অবস্থায় একা দেখতে পেয়ে ছেলেরা আমাদের সন্ধানে এখানে এসে পৌঁচেছে।
যে দুজন শববাহক ভিতরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তারা আর কখনো জ্ঞান ফিরে। পায়নি। যে বাইরে এসে ভিরমি গিয়েছিল, সে পরে সুস্থ হল বটে, কিন্তু তার মাথা এখনো সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি—আর যে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছিল তাকে এখনো পাগলা গারদে বেঁধে রাখা হয়েছে। একমাত্র দস্তুর’জীই এই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।
অথচ ব্যাপারটা পরে পরিষ্কার বোঝা গেল। বুড়ি ছিল হাড্ডিসার, গায়ে একরত্তি চর্বি ছিল না, যেটুকু মাংস ছিল তা না থাকারই শামিল। তিন মাসের গরমে বুড়ী শুটকি হয়ে এমনি এক অদ্ভুত ধরনে বেঁকে গিয়েছিল যেন পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে উঠে বসেছে—শুধু চোখ দুটো একদম উপে গিয়েছে। সর্বশরীরের কোথাও এতটুকু আঁচড় নেই—আপনাকে আগেই বলেছি মধুগাঁও থেকে সব শকুন বহুদিন পূর্বেই পালিয়ে গিয়েছিল।