বললেন, ‘খাই না তো, হঠাৎ ও রকম অকালে বৃষ্টি না নামলে।
মদ খাওয়ার নানা অজুহাত বাজারে চালু আছে। এটা নতুন। বৃষ্টির জলের সঙ্গে নামল বটে, কিন্তু ধোপে টিকবে না। বললুম হু’।
আপনিও খেতেন।
‘? ? ? ?’
‘সে অবস্থায় পড়লে।’
আমি শুধালুম, ‘কোন অবস্থায়?’ তারপর বললুম, ‘কিন্তু আপনি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন কেন? বিশেষত আপনার ধর্মে যখন ও জিনিস বারণ নয়।’
‘আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি কারণ আর সবাই জানে—
আমি বললুম, তাহলে বলুন।
বললেন, ‘রুস্তম বলছিল, আপনি নাকি পুব-ভারতের লোক, পার্সীদের আচারব্যবহার পালা-পরব সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। টাওয়ার অফ সায়লেন্স কাকে বলে জানেন?
আবার ‘মৌন শিখর’! বললুম, আজই প্রথম শুনেছি।
বললেন, ‘কুয়োর মতো গোল করে গড়া হয়। আর দেয়ালের ভিতরের দিকে বড় বড় শেলফের মতো কুলুঙ্গি বা নিশ’ কাটা থাকে। সেগুলোর উপর মড়াকে বিবস্ত্র করে শুইয়ে দেওয়া হয়। বোম্বাই-টোম্বাই অঞ্চলে বিস্তর শকুনি ওত পেতে বসে থাকে, তিন মিনিটের ভিতর হাড্ডিগুলো ছাড়া সব কিছু সাফ করে দেয়। কিন্তু ভিতরে গিয়ে এসব দেখবার হুকুম নেই। একমাত্র শববাহকই ভিতরে যায়। এই যে নওজোতের সময় ‘দস্তুর’দের দেখলেন তেমনি পার্সীদের ভিতরে বিশেষ ‘শববাহক’ সম্প্রদায় আছে। টাওয়ার অফ সায়লেন্সের ভিতর যা কিছু করার তারাই সব করে। এমন কি ‘দস্তুর’দেরও ভিতরে যাওয়া বারণ।
আমার জন্ম মধুগাঁয়ে, সেখানেই প্রায় সমস্ত জীবন কাটিয়েছি। মধুগাঁও সি. পি.-তে। আ’নি কখনো যাননি? তাহলে বুঝতেন গ্রীষ্মকালে সেখানে কী রকম গরম পড়ে। আর সে গরম একদম শুকনোবোন-ড্রাই। দেয়ালের কেলেন্ডার বেঁকে যায়, বইয়ের মলাট বাঁকতে বাঁকতে কেতাব থেকে খসে পড়ে, টেবিলটা পর্যন্ত পিঠ বাঁকিয়ে বেড়ালটার মতো লড়াইমুখো হয়ে ওঠে। এমনকি মানুষদেরও রসকষ শুকিয়ে যায়। হাতাহাতির ভয়ে গরমের দিনে একে-অন্যে কথাবার্তা পর্যন্ত হয় নিক্তি-মেপে।
সেই গরমে মারা গেল এক আশী বছরের হাড্ডিসার বুড়ি। আমার ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন যুবতী–বকা ছোঁড়ারা তখনই তার নাম দিয়েছিল ‘ঝরাপাতা’, ‘কুকুরের জিভ’। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকোতে শুকোতে শেষ পর্যন্ত রইল চামড়ায় জড়ানো খানকয়েক হাড্ডি। আর স্বভাব ছিল এমনি খিটখিটে যে আমরা পারতপক্ষে তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেতুম না। বিশ্বাস করবেন না, বেটি বারান্দায় বসত এক গাদা নুড়ি নিয়ে। কেউ ভুলেও তার বাড়ির সামনে দাঁড়ালে নুড়ি ছুঁড়তে আরম্ভ করত তাগ করে আর সে কী মোক্ষম তাগ! ‘প্র্যাকটিস মেকস পার্ফেক্ট’ রচনায় এক ছোঁড়া বুড়ির উদাহরণ দিয়ে আমার কাছ থেকে ফুলমার্ক পেয়েছিল।
বুড়ির ত্রি-সংসারে কেউ ছিল না, প্রকাণ্ড একটা কুকুর ছাড়া। কিন্তু কুকুরটার উপর তো আর বুড়ির শেষ ক্রিয়ার ভার ছেড়ে দেওয়া যায় না। ভারটা পড়লো আমাদের ঘাড়েই। মহাবিপদে পড়ল মধুগাঁয়ের পার্সী সম্প্রদায়।
এককালে মধুগাঁয়ে বিস্তর পাসী বসবাস করতো বলে তারা শহরের মাইলখানেক দূরে ভাল টাওয়ার অফ সায়লেন্স বানিয়েছিল। আপন শববাহক’ও জনআষ্টেক ছিল। কিন্তু সে হল সত্তর-আশি বৎসরের কথা। ইতিমধ্যে পার্সী সংখ্যা ক্রমে-ক্রমে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র দশ-বারোটি পরিবারে। তাই মৃত্যুর হার এসে দাঁড়িয়েছে বছরে এক কিংবা তার চেয়েও কম। টাওয়ার অফ সায়লেন্সের শকুনগুলো পর্যন্ত পালিয়েছে না খেয়ে মরমর হয়ে। মানুষের বুদ্ধি শকুনের চেয়ে বেশি, তাই শববাহকের দল শকুনগুলোর বহুপূর্বেই মধুগাঁও ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
তাই সমস্যা হল বুড়িকে বয়ে নিয়ে যাবে কে? এসব ব্যাপারে পার্সীরা বামুনদের চেয়ে তিনকাঠি বেশি গোঁড়া। শববাহক’ না হলে তো চলবে না—বরঞ্চ পার্সী সম্প্রদায় নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে তিন দিন কাটিয়ে দেবে তবু শববাহক’ ভিন্ন কেউ মরা ছুঁতে পারবে না।
টেলিগ্রাম করা হল এক আঁটা—চতুর্দিকের পার্সীদের কাছে, পাসী-ধর্ম লোপ পায়, পার্সী-ঐতিহ্য গেল গেল, তোমরা সব আছো কী করতে, চারটে শববাহক না পেলে মধুগাঁও উচ্ছন্নে যাবে, সৃষ্টি লোপ পাবে।
শববাহকেরা শেষটায় এল। এক ছোকরা দস্তুর’ তখনো মিসিং লিঙ্কের ন্যাজের মতো খসি-খসি করে মধুগাঁয়ের পশ্চাদ্দেশে ঝুলছিল, সে মন্তর-ফন্তরগুলো সেরে দিলে— হোলি জিসসই জানেন তার কতটা শুদ্ধ কতটা ভুল।
সেই মার্চ মাসের আগুনের ভিতর দিয়ে চারটে শববাহক, দস্তুর’জী আর আমারই মতো আরো দুই মুখ গেলুম টাওয়ার অফ সায়লেন্সে। গেটের কাছে শববাহক ছাড়া আর সবাইকে দাঁড়াতে হল। একটা গাছ পর্যন্ত নেই যার ছাওয়ায় একটু কম গরম হই। সান্ত্বনা এইটুকু যে শববাহকেরা রেকর্ড টাইমের ভিতর বেরিয়ে এল। গেটে তালা মেরে আমরা সবাই ধুকতে ধুকতে শহরে ফিরে এলুম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম আর যদি কখনো ঐ হতভাগা টাওয়ারে যেতে হয় তবে যাব, শেষবারের মততা, শববাহকদের কাঁধে চেপে।
কিন্তু খুদার কেরামতির কে ভেদ করবে বলো? তিন মাস যেতে না যেতে মরলেন আমার বিধবা পিসি—বাবা বিদেশে, মা বহুকাল পূর্বেই গত হয়েছেন। বাড়িতে সোমখ আর কেউ নেই। আমি পাগলের মতো শববাহকের সন্ধানে দুনিয়ার চেনা-অচেনা সবাইকে তার করলুম। মে মাসের অসহ্য গরম পড়েছে আকাশ ভেঙে—মধুগয়ে যে ক’ ফোঁটা বিষ্টি হয় সে জুলাই মাসে, তার পূর্বে ও-মুলুকে কখনো মেঘ করেনি, বৃষ্টি ঝরেনি। ধরণী যে ঠাণ্ডা হবেন তার কোনো আশা-ভরসা নেই জুলাই মাস পর্যন্ত। দস্তুরটিও ইতিমধ্যে ন্যাজটার মতো খসে পড়েছেন, তারই বা সন্ধান পাই কোথায়?