পার্সীদের পাল্লায় পড়লে বুঝতেন। রোববার বিকেলবেলা রুস্তম বউ, বেটাবাচ্চা নিয়ে গাড়ি করে আমার বাড়িতে উপস্থিত—পাছে আমি ফাঁকি দিই।।
গাড়িতে বসে বললেন, ‘পার্সীদের কী নাম দিয়েছে আর সব গুজরাতিরা জানেন? কাগড়া’ অর্থাৎ ক্রো। তার প্রথম কারণ, আমরা কালো কোট টুপি পরি, দ্বিতীয় কারণ পাঁচটা পার্সী একত্র হলেই কাকের মতো কিচিরমিচির করি, তৃতীয় কারণ কাকের মতো খাদ্যাখাদ্য বিচার করিনে—জানেন তো আর সব গুজরাতিরা শাকখেকো—চতুর্থ কারণ আমাদের নাকটা কাকের মতো বাঁকানো, আর শেষ কারণ মরে গেলে কাকে আমাদের মাংস খায়। তারপর হো-হো করে খুব খানিকটা হেসে বললেন, ‘গুজরাতিদের রসবোধ নেই সবাই জানে, কিন্তু এ রসিকতাটা মোক্ষম।
আমি বললুম, সব হিন্দুই একবার স্মোক করে, সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাক আর নাই থাক, সেটা জানেন?
বললেন, কী রকম?
তাদের তো পোড়ানো হয়, দেন দে স্মোক।
কশফদরৌশন বললেন, ‘তবু ভালো, শকুনির ছেড়াঘেঁড়ির চেয়ে স্মোক করা ঢের ভালো।
আমি বললুম, ‘কেন? চারটে শকুনি যদি এক পেট খেতে পায় তাতে আপত্তিটা আর কী? এই আপনাদের বোমানজী যদি জ্যান্ত অবস্থায় কাউকে খাওয়াতে না চায় তবে না হয় মরে গিয়েই খাওয়ালো।
রৌশন বললেন, আপনি জানেন না তাই বলছেন। বোম্বায়ে টাওয়ার অফ সায়লেন্সের আশপাশের কোনো বাড়িতে কখনো বাসা বাঁধলে জানতেন। একটা শকুনি হয়তো একটা মরা বাচ্চার মাথাটা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আপনার বাড়ির উপর দিয়ে, আরেক শকুনির সঙ্গে লাগলো তখন তার লড়াই। ছিটকে পড়ল মুণ্ডুটা আপনার পায়ের কাছে, কিংবা মাথার উপরে। ভেবে দেখুন তো অবস্থাটা। তিন বছরের বাচ্চার মুণ্ডু, গলাটা ছিঁড়েছে শকুনে—’
আমি বললুম, ‘থাক, থাক।’ কিন্তু আশ্চর্য, ওয়াডিয়ার বাচ্চা দুটো শিউরে উঠলো না কিংবা মাকে এ সব বীভৎস বর্ণনা দিতে বারণ করল না। অনুমান করলুম, এরা ছেলেবেলা থেকেই এ-বিষয়ে অভ্যস্ত।
নওজোত অনুষ্ঠান হচ্ছিল একটা প্ল্যাটফর্মের উপর। সাদা জাজিমে মোড়া। দুটি আটন বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে, আর চারজন দস্তুর’ (পুরোহিত) আবেস্তা, পহুবী ভাষায় গড়গড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। এককালে যজ্ঞোপবীত দেবার সময় পুরোহিত ছেলেটাকে মন্ত্রোচ্চারণ দিয়ে বোঝাতেন যজ্ঞোপবীতের দায়িত্ব কী, আজ যে সে উপবীত ধারণ করতে যাচ্ছে তার অর্থ-মায়ের কোল আর খেলাধুলো তার জন্য শেষ হল, সে আজ সমাজে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এখন কটা ছেলে এ সব বোঝে তা জানিনে, কিন্তু এটা স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, নওজোত’-ও উপনয়নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে—যে মন্ত্র উচ্চারণ করা হচ্ছে তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে।
ফিসফিস করে কথা বলতে মানা নেই। আমি রুস্তমকে আমার গবেষণামূলক তত্ত্ব চিন্তাটি অতিশয় গাম্ভীর্য সহকারে নিবেদন করাতে তিনি বললেন, আপনার তাতে কী, আমারই বা তাতে কী? রান্নাটা ভালো হলেই হলো।
বুঝলুম, ইতর জনের জন্য মিষ্টান্ন’—প্রবাদটি সর্বদেশে প্রযোজ্য।
নওজোত শেষ হয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে নামল ঝমাঝঝম বৃষ্টি। অকালে এ রকম বৃষ্টির জন্য কেউ তৈরি ছিলেন না। নিমন্ত্রিত-রবাহূত সবাই ছুটে গিয়ে উঠলেন বাড়ির বারান্দায়। তারপর বৃষ্টির ঝাপটা খেয়ে, একদল ড্রইংরুমে, আরেক দল ডাইনিং রুমে, আত্মীয়-কুটুমরা বেডরুমে ঢুকলেন। আমাকে রুস্তম নিয়ে গেলেন ছোট্ট একটা কুঠুরিতে, বোধ হয় বাচ্চা দুটোর পড়ার ঘর।
আমরা জনা বারো সেই কুঠুরিতে কাঁঠাল-বোঝাই হয়ে বসলুম। সকলের শেষে এসে ঢুকলেন এক বুড়ো পার্সী দু’বগলে দু’বোতল মদ নিয়ে। আমরা কয়েকজন হিন্দু-মুসলমান নিরামিষ ছিলুম, আমাদের জন্য এল আইসক্রীম, লেমনেড।
বুড়ো একটা বোতল ছেড়ে দিলেন মজলিসের জন্য। অন্য বোতলটা নিজে টানতে লাগলেন নির্জলা। বিলেতে পালা-পরবে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মদ খাওয়া হয়, তাই আমি এন্তার মদ খাওয়া দেখেছি। কিন্তু দশ মিনিট যেতে না যেতেই বুঝলুম, এ বুড়ো তালেবর ব্যক্তি। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে পেশাদারী ব্রাহ্মণের পাইকারি বহান্ন ভক্ষণের মতো এর পাইকারি পান দ্রষ্টব্য বস্তু।
মদ খেলে কেউ হয়ে যায় ঝগড়াটে, কেউ বা আরম্ভ করে বদ রসিকতা, কেউ করে খিস্তি, কেউ হয়ে যায় যীশুখ্রষ্ট-দুনিয়ার তাবৎ দুঃখকষ্ট সে তখন আপন স্কন্ধে তুলে নিতে চায়, আর সবাইকে গায়ে পড়ে টাকা ধার দেয়। পরের দিন অবশ্য চাকরের উপর চালায় চোট-পাট, ভাবে (পার্সী হলে) ঐ শালাই মোকা পেয়ে টাকাটা লোপাট মেরেছে।
আমি গিয়েছিলুম এক কোণে, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসব বলে। বোতলটি আধঘন্টার ভিতর শেষ করে বুড়ো এসে বসলেন আমারই পাশে। আমি একটু সঙ্কুচিত হয়ে স্থান করে দিলুম। বুড়ো শুধদলেন, আপনি এশহরে নতুন এসেছেন? আমি কীর্তিটা অস্বীকার করলুম না। বললেন, তাই ভাবছেন আমি মাতাল?
বুঝলুম ইনি যীশুখ্রীষ্ট টাইপ নন, ইনি হচ্ছেন মেরি ম্যগডলীন টাইপ। অনুশোচনায় ক্ষতবিক্ষত। বললুম, কই আপনি তো দিব্য আর পাঁচজনের মতো কথা কইছেন!
বললেন, এক বোতলে আমার কিছু হয় না, পাঁচ বোতলেও কিছু হয় না, দশ বোতলেও না—যদিও অতটা কখনো খেয়ে দেখিনি।
সত্যি লোকটার গলা সাদা, চোখের রঙ থেকেও বিশেষ কিছু অনুমান করা যায় নাবুড়োবয়সের ঘোলাচোখে রঙের ফেরফার সহজে ধরা পড়ে না। পাকা বাঁশে তেল লাগালেও একই রঙ।
বললুম, তাহলে না খেলেই পারেন।