পোর্টার হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। সিবিলাকে আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিল।
গাড়ির গায়ে চলার পূর্বের কাপন লেগেছে। এমন সময় আমার আর সিবিলার কামরার মাঝখান দিয়ে একটি মহিলা ধীরে-সুস্থে ছোট্ট একটি ছেলের হাত ধরে ধরে চলে গেলেন। সিবিলা দোরে দাঁড়িয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করল কি না বলতে পারিনে, হঠাৎ দরজা খুলে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল।
আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চা কেড়ে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
আমি বাধা দিলাম না।
রাক্ষসী
আরাম-আয়েশ ফুর্তি-ফার্তির কথা বলতে গেলেই ইংরেজকে ফরাসী শব্দ ফরাসী ব্যঞ্জনা ব্যবহার করতে হয়। ‘জোয়া দ্য ভিভ্র্’ (শুদ্ধমাত্র বেঁচে থাকার আনন্দ), ‘বঁ ভিভ্র্’ (আরামে আয়েশে জীবন কাটানো), ‘গুরমে’ (পোষাকি খুশখানেওলা), ‘কনেস্যর’ (সমঝদার, রসিকজন) এসব কথার ইংরিজি নেই। ভারতবর্ষে হয়তো এককালে ছিল, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ছিল—মৃৎশকটিকা, মালতীমাধব নাট্যে আরাম-আয়েশের যে চৌকশ বর্ণনা পাওয়া যায় তার কুল্লে মাল তো আর গুল-মারা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না—আজ নেই এবং তার কারণ বের করার জন্যও ঘেরণ্ড সংহিতা ঘাটতে হয় না। রোগশোক অভাব অনটনের মধ্যিখানে ‘গুরমে’ হওয়ার সুযোগ শতেকে গোটেক পায় কিনা সন্দেহ—তাই খুশ-খানা, খুশ-পিনা বাবদের কথাগুলো বেবাক ভারতীয় ভাষা থেকে লোপ পেয়ে গিয়েছে, নতুন বোল-তানের প্রশ্নই ওঠে না।
তবু এই ‘বঁ ভিভ্রের’ কায়দাটা এখনো কিছু জানে পশ্চিম ভারতের পার্সী সম্প্রদায়। খায়দায়, হৈ-হুল্লোড় করে, মাত্রা মেনে ফষ্টিনষ্টি ইয়ার্কি-দোস্তি চালায় এবং তার জন্য দরকার হলে ঋণং কৃত্বা নীতি মানতেও তাদের আপত্তি নেই। তাজ হোটেলে বসে মাসের মাইনে এক রাত্তিরে ফুকে-দেনেওলা বিস্তর পার্সী বোম্বাইয়েই আছে। আর গোলাপী নেশায় একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে কোনো পার্সী ছোকরা যদি ল্যাম্পপোস্টটাকে জড়িয়ে ধরে ভাই, এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি’ বলে ঝপাঝপ গণ্ডাদশেক চুমো খেয়ে ফেলে তাহলে তার বউ হয় স্ন্যাপশট তোলে, নয় ‘চ, চ, বাইরাম তোর নেশা চড়েছে বলে ধাক্কাধাক্কি দিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। পরদিন ক্লাবে বসে বউ পাগলা বাইরামের কীর্তি-কাহিনীতে বেশ একটুখানি নুন-লঙ্কা লাগিয়ে মজলিস গরম করে তোলে, আর বাইরামের বাপ গল্প শুনে মিটমিটিয়ে হাসে, ব্যাটার এলেম’ হচ্ছে দেখে আপন ঠাকুর্দার স্মরণে খুশি হয়ে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে।
গাওনা বাজনায় ভারি শখ। একদল বেটোফেন-ভাগনার নিয়ে মেতে আছে, আরেকদল বরোদার ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের সাকরেদী করে। আর লান্না লালা লা’ গান গেয়ে নাকি বহু পাসী বাচ্চা মায়ের গর্ভ থেকে নেমে এসেছে।
অন্য কোনো সম্প্রদায় সম্বন্ধে এ-সব কথা বলতে আমি সাহস পেতুম না, কিন্তু পার্সীদের ঈষৎ রসবোধ আছে, তা সে সূক্ষ্মই হোক, আর স্কুলই হোক। আলাপ জমাতেও ভারি ওস্তাদ। বিদেশীকে খাতির করে ঘরে নিয়ে যায়, বাড়ির আর পাঁচজনকে নতুন চিড়িয়া দেখাবে বলে। তাকে কাঠি বানিয়ে সবাই মিলে তার চতুর্দিকে চর্কিবাজির নাচন তুলবে বলে।
তাই বরোদা পৌঁছবার তিনদিনের ভিতরই রুস্তম দাদাভাই ওয়াডিয়া গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে আলাপচারী করলেন, বাড়ি নিয়ে গিয়ে বুড়ো বাপ, বউ, তিন ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরের দিনই পার্সী সম্প্রদায়ের ধানসাক (আমাদের লুচিমণ্ডা) খাবার নেমন্তন্ন পেলুম। এবং সেদিনই খানা শেষে বললেন, আসছে রোববার সন্ধ্যেয় বোমানজী নারিমানের দু’ছেলের নওজোত। আপনার নেমন্তন্ন রয়েছে। আসবেন তো?
আমি তো অবাক। এ দুনিয়ায় পার্সী বলতে আমি মাত্র এই.ওয়াডিয়া পরিবারকেই চিনি। বোমানজী নারিমান লোকটি কে, এবং আমাকে নেমন্তন্ন করতে যাবেই বা কেন? আমি বললুম, নারিমানকে তো চিনিনে।
ওয়াডিয়া বললেন, চিনে আপনার চারখানা হাত গজাবে নাকি (পার্সীরা ইয়ার্কি না করে কথা কইতে পারে না)? খাওয়ায় ভালো-সেইটে হল আসল কথা। এই নিন আপনার কার্ডও দিয়েও আপনার চারখানা হাত গজাবে না। আপনি ভাববেন না আমি নারিমানের দোরে ধন্না দিয়ে এ কার্ড বের করেছি। আপনার সঙ্গে আমাদের জমে গিয়েছে নারিমান সেটা নিজের থেকেই জানতে পেরে কার্ডটা পাঠিয়ে দিয়েছে। না পাঠালে অবিশ্যি আমি একটুখানি নল চালাতুম—আপনার মতো গুণীকে বাদ দিয়ে—
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘আমি গুণী!
ওয়াডিয়া বললেন, ‘বাঁধা ছালার দাম পঁচিশ লাখ। দু দিন বাদে সব শালা (পার্সীরা এই শব্দটি প্রায় সবকথার পিছনেই লাগায়) আপনাকে চিনে নেবে, কিছু ভয় নেই। তদ্দিন দু পেট খেয়ে নিন। নারিমানের ছেলেদের নওজোতের পরে আসছে সোরাবজীর মেয়ের বিয়ে, তারপর আসছে—
আমি জিজ্ঞেস করলুম, নওজোত পরবটা কী?
বললেন, ‘এলেই দেখতে পাবেন। হিন্দুদের যেমন পৈতে হয়, পার্সীদের তেমনি নওজোত। শুধু কস্তি’ অর্থাৎ পৈতেটা বাঁধতে হয় কোমরে, আর সঙ্গে পরতে হয় একটি ছোট্ট ফতুয়া—তার নাম সদরা। এই ‘কস্তি’-‘সদরা’ দুয়ে মিলে হল পার্সীদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তি।
ওয়াডিয়ার বউ রৌশন বললেন, যত্ত সব সিলি সুপারস্টিশনস!
রুস্তম বললেন, লঙ লিভ সচ সুপারস্টিশনস। এদেরই দৌলতে দু মুঠো খেয়ে নিই। শালা বোমানজীর পেটে বোমা মারলেও সে এক পেট খাওয়ায় না। তার বাপ শালা (সবাই শালা!) বিয়ে করেছিল বিলেতে, শ্যাম্পেনটা-কেকটা ফাঁকি দেবার জন্য।