আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছি ঝাঁকুনিতে কাঁচা বাচ্চার অনিষ্ট হয় কি না হয় তা তো জানিনে। থেকে থেকে সিবিলা আমার কাঁধের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করছে, আপনি ঠিক জানেন যাঁদের বাড়িতে আমার বুবি যাচ্ছে তারা ভালো লোক? আমি আমার সাধ্যমতো তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছি আর ভাবছি কর্তা এলেই ভালো হত। তিনি সমস্ত জিনিসটা নিশ্চয়ই আরো গুছিয়ে করতে পারতেন।
সিবিলা একই প্রশ্ন বারে বারে শুধায়, তারা লোক ভালো তো? আমি ভাবছি যদি শুধায় তারা ভালো আমি কী করে জানলুম, তা হলেই তো গেছি। আমার কেন কর্তারও তো সে সম্বন্ধে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। কিন্তু যখন সিবিলা সে প্রশ্ন একবারও শুধালো না তখন বুঝতে পারলুম, তার কাছে অজানার অন্ধকার আধা-আলোর দ্বন্দ্বের চেয়ে অনেক বেশি কাম্য হয়ে উঠেছে। জেরা করলে যদি ধরা পড়ে যায়—যদি ধরা পড়ে যায় যে আমার উত্তরে রয়েছে শুধু ফাঁকি? তখন? তখন সে মুখ ফেরাবে কোন দিকে, কোথায় তার সানা?
সিবিলা বলল, গাড়ি থামান একটু দয়া করে। ঐ তো খেলনার দোকান। আমার বুবির তো কোনো খেলনা নেই। তাইতো, কা, আমি দুজনেই এদিকে একদম খেয়াল করিনি। কিন্তু একমাসের শিশু কি খেলনা বোঝে?
একগাদা খেলনা নিয়ে সিবিলা গাড়িতে ঢুকল।
দশ পা যেতে না যেতেই সিবিলা বলল, ঐ তো জামা-কাপড়ের দোকান। বুবির তো ভাললা জামা নেই। গাড়ি থামান। থামালুম। এবার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে সে দোকানে ঢুকলো, জিনিস বয়ে আনতে অসুবিধে হতে পারে ভেবে আমিও সঙ্গে গেলুম।
দোকানি যেটা দেখায় সেটাই কেনে। কোনো বাছবিচার না, দাম জিজ্ঞেস করা না। দোকানি পর্যন্ত কেনার বহর দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘বুবির এখন বাড়ন্ত বয়স, জামাগুলো দুদিনেই ছোট হয়ে যাবে না?
বলে করলুম পাপ। সিবিলা বলল, ঠিকতো’—আর কিনতে আরম্ভ করল সব সাইজের জামা, পাতলুন, মোজা, টুপি। আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে শেষটায় বললুম, ফ্রলাইন সিবিলা, ট্রেনের বেশি দেরি নেই। সিবিলা বলল, চলুন।
আরো দশ পা। সিবিলা হকুম করল, থামান।
এবারে কী কিনল ভগবানই জানেন।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দোকানপাট একটা একটা করে বন্ধ হতে আরম্ভ করেছে। সিবিলা বলে, থামান’, সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত গাড়ি থেকে নেবে পড়ে, আর ছুটে গিয়ে দোকানিকে দরজা বন্ধ করতে বারণ করে। যে-দোকান দেখে বন্ধ হচ্ছে, ছুটে যায় সে-দোকানেরই দিকে। ছুটোছুটিতে চুল এলোথেলো হয়ে গিয়েছে, পাগলিনীর মতো এদিক-ওদিক তাকায়-সে একাই লড়বে সব দোকানির সঙ্গে। কেন? একদিনের তরে তারা দোকানগুলো দুমিনিট বেশি ভোলা রাখতে পারে না? আমি বার বার অনুনয় করছি, ফ্রলাইন সিবিলা, বিট্টে বিট্টে, প্লীজ প্লীজ, জায়েজী ফেরনুনটি, একি করছেন? গাড়ি ধরব কী করে? সিবিলা কোনো কথায় কান দেয় না। আমার মাথায় কুবুদ্ধি চাপল, ভাবলুম একটু জোরজার করি। বললুম, এত সব জিনিসের কী প্রয়োজন?
চকিতের জন্য সিবিলা বাঘিনীর ন্যায় রুখে দাঁড়াল। হুঙ্কার দিয়ে কী? বলেই থেমে গেল। তারপর হঠাৎ ঝরঝর করে চোখের জল বেরিয়ে এল।
চাচা বললেন, আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। খোদর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলুম সিবিলার পরীক্ষা সহজ করে দেবার জন্য।
তারপর আমি আর বাধা দিইনি। যায় যাক দুনিয়ার বেবাক ট্রেন মিস্ হয়ে। বিশ্বসংসার যদি তার জন্য আটকা পড়ে যায় তবে পড়ুক। আমি বাধা দেব না।
বোধ হয় টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। সিবিলা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের কাছে আমার আর কোনো পাওনা আছে? আমি বললুম, না, কিন্তু আপনার যদি প্রয়োজন হয় তবে আমি দিতে পারি। বলল, ‘পাঁচটা মার্ক দিন, একখানা আ-বে-সের বই কিনব।
এক মাসের শিশু বই পড়বে।
গাড়ির পিছনটা জিনিসে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। সিবিলা বাচ্চাকে নিয়ে আমার পাশে বসল। তার হাতের বেলুন উড়ে এসে আমার স্টিয়ারিঙে বাধা দিচ্ছে। সিবিলার সেদিকে হৃক্ষেপ নেই।
স্টেশনে যখন পৌঁছলুম, তখন গাড়ি আসতে কয়েক মিনিট বাকি। গোডেসবের্গ ছোট স্টেশন, ডাকগাড়ি দু’মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না। আমি বাচ্চাটাকে নেবার জন্য হাত বাড়ালুম কোনো কথা না বলে। সিবিলা বলল, ‘প্ল্যাটফর্মে চলুন, গাড়ি ছাড়লে পর—’। আমি কোন কথা না বলে এগিয়ে চললুম।
পোর্টারই দেখিয়ে দিল কোন জায়গায় দাঁড়ালে সেকেন্ড ক্লাস ঠিক সামনে পড়বে। আমি সিবিলাকে আরো পঞ্চাশটি মার্ক দিলুম।
সিবিলা সিগনেলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের অন্ধকারের মাঝখানে তার দৃষ্টি ডুবে গিয়েছে। তার কোলে বুবি। ভগবানের জুই একরাতেই শুকিয়ে যায়, সিবিলার জুই যেন অক্ষয় জীবনের আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুমুচ্ছে।
সিবিলা আমার হাতে বাচ্চাকে তুলে দিল। একমুহূর্তের তরে সব কিছু ভুলে গিয়ে বলল, আপনি তো বেশ বাচ্চা কোলে নিতে জানেন! আমাদের পুরুষরা তো পারে না।
আমি আরাম বোধ করলুম। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। পোটার সিবিলার সুটকেস তুলে দিয়েছে।
হঠাৎ সিবিলা সেই পাথরের প্ল্যাটফর্মে হাঁটুগেড়ে আমার দু হাঁটু জড়িয়ে হা-হা করে কেদে উঠল। সে কান্নায় জল নেই, বাষ্প নেই। বিকৃত কণ্ঠে বলল
আমায় কথা দিন, ঈশ্বরের শপথ, কথা দিন আপনি বুবির খবর নেবেন সে ভালো আছে কি না। মা মেরির শপথনা, না, মা মেরির না—আপনার মায়ের শপথ, কথা দিন।
আমি আমার মায়ের নামে শপথ করলুম। পাটি যা বলে বলুক, যা করে করুক।