আর এ-মেয়েও তো মা হবে।
থাক সেসব কথা। শেষটায় স্থির হল যে কিছুই স্থির করবার উপায় নেই। উপস্থিত সিবিলা কাজ করে যাক, যখন নিতান্তই অচল হয়ে পড়বে তখন তাকে নার্সিংহোমে পাঠানো হবে। আমি পরে কর্তাকে বললুম, কিন্তু বাচ্চাটার কী গতি হবে সে কথাটা তো কিছু ভাবলেন না। কর্তা বললেন, এখন ভেবে কোনো লাভ নেই। বিপদ-আপদ কাটুক, তখন বাচ্চার প্রতি সিবিলার কী মনোভাব সেইটে দেখে ব্যবস্থা করা যাবে।
প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সিবিলা কাজ করেছিল। কিন্তু শেষের দিকে তার গান গাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার বোন এমনিতে গান গাইত না। সে শেষের দিকে গুনগুন করতে আরম্ভ করেছিল।
বাচ্চা হল। আহা, যেন একমুঠো জুই ফুল!
কিন্তু তখন আরম্ভ হল আসল বিপদ। বাচ্চাকে অনাথ আশ্রমে দিতে সিবিলা কিছুতেই রাজি হয় না। বলে, কোনো পরিবারে যেন সে আশ্রয় পায়। কিন্তু এরকম পরিবার পাওয়া যায় কোথায়? অনুসন্ধান করলে যে পাওয়া একেবারে অসম্ভব তা নয়, কিন্তু জর্মনির সে দুর্দিনে, ইনফ্রেশনের গরমিতে মানুষের বাৎসল্যরস শুকিয়ে গিয়েছে—আর তার চেয়েও বড় কথা, অতটা সময় আমাদের হাতে কই?
রোজ হয় ফোন, নয় চিঠি। নার্সিংহোম বলে সিবিলাকে নিয়ে যাও। এখানে বেড় দখল করে সে শুধু আসন্নপ্রসবাদের ঠেকিয়ে রেখেছে।
এদিকে কর্তা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন, পয়সা দিয়ে এজেন্সির লোককে লাগানো, আপন বন্ধুবান্ধবদের কাছে অনুসন্ধান কিছুই বাদ দেননি। আমাকে পর্যন্ত দুতিনবার কলন, ডুসেলডর্ষ হয়ে আসতে হল। নার্সিংহোমের তাড়া খেয়ে কর্তার ভূঁড়ি গিরে আষ্টেক কমে গেল। কী মুশকিল!
সব কিছু জানতে পেরে তখন সিবিলাই এক আজব প্যাঁচ খেলে আমাদের দম ফেলার ফুর্সৎ করে দিল। নার্স তো বটে, এমনি এক বিদঘুটে ব্যানোর খাসা ভান করলে যে পাঠশালার মিটমিটে শয়তান আর হলিউডের ভ্যাম্পে মিললেও ফল এর চেয়ে ভালো ওতরাতো না। কুট হামসুন বলেছেন, ‘প্রেমে পড়লে বোকা বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, বুদ্ধিমান বোকা হয়ে যায়। সিবিলার মতো ভিতরে-বাইরে সাদামাটা মেয়ে বাচ্চার মঙ্গলের জন্য ফন্দিবাজ হয়ে উঠলো।
এমন সময় কর্তাকারবারে যাকে বলে ভালো পার্টির খবর পেলেন। অগাধ পয়সা, সমাজে উঁচু, শিক্ষিত পরিবার। কিন্তু আমাদের এজেন্ট বলল ‘পার্টি’—অর্থাৎ ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী-কড়া শর্ত দিয়েছেন যে সিবিলা এবং আমাদের অন্য কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পাবে না, এবং কথা দিতে হবে যে জানবার চেষ্টা করবে না, যে কারা সিবিলার বাচ্চাকে গ্রহণ করলেন। এ শর্ত কিছু নতুন নয়, কারণ কল্পনা করা কিছু অসঙ্গত নয় যে সিবিলা যদি একদিন হঠাৎ তার বাচ্চাকে ফেরত চেয়ে বসে তখন নানা বিপত্তি সৃষ্টি হতে পারে। আর কিছু না হোক বাচ্চাটা যদি জানতে পেরে যায় তার আসল মা কে, তাহলেই তো উৎকট সঙ্কট।
কর্তার মতো ব্যবসায়ের পাঁজে পোড়-খাওয়া ঝামাও এ-প্রস্তাব নিয়ে নার্সিংহোমে যাননি। সব কিছু চিঠিতে লিখে জানিয়েছিলেন। দুদিন পরে উত্তর এল, সিবিলা রাজি।
মনস্থির করতে সিবিলার দুদিন লেগেছিল। সে আটচল্লিশ ঘন্টা তার কী করে কেটেছিল, জানি না। বাড়িতে আমরা তিনজন নিঃশব্দে লাঞ্চ-ডিনার খেয়েছি, একে অন্যে চোখাচোখি হলেই একসঙ্গে সিবিলার দ্বিতীয় প্রসব-বেদনার কথা ভেবেছি। আইন মানুষকে এক পাপের জন্য সাজা দেয় একবার, সমাজ কতবার, কত বৎসর ধরে দেয় তার সন্ধান কোনো কেতাবে লেখা নেই, কোনো বৃহস্পতিও জানেন না।
ট্রাঙ্ক-কলে ট্রাঙ্ক-কলে সব বন্দোবস্ত পাকাঁপাকি করা হল। কর্তা সিবিলাকে নিয়ে স্টেশনে যাবেন। পার্টি’র ওয়েট-নার্স (ধাই) বাচ্চার জন্য ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করবে। সিবিলা স্টুটগার্টের ট্রেন ধরলে পর কর্তা বাচ্চাটিকে সেই ধাইয়ের হাতে সঁপে দেবেন। ‘পার্টি’ কড়াক্কড় জানিয়েছেন, সিবিলা যেন ওয়েট-নার্সকেও না দেখতে পায়।
যে দিন সিবিলাকে নিয়ে স্টেশনে যাবার কথা, সেদিন দুপুরবেলা কার্লের গলা দিয়ে একঝলক রক্ত উঠল। ছ’মাস ধরে টেম্পারেচর, স্যটাম কাবুতে এসে গিয়েছিল, এ-পি বন্ধ ছিল, তারপর হঠাৎ সাদা দাঁতের উপর কঁচা রক্তের নিষ্ঠুর ঝিলিমিলি। আমরা তিনজনাই সামনে ছিলাম। কর্তারই কী একটা রসিকতায় হাসতে গিয়ে ব্যাপারটা ঘটল। ছেলের মন ভালো রাখবার জন্য ভদ্রলোক অনেক ভেবেচিন্তে রসিকতাখানা তৈরি করেছিলেন। অবস্থাটা বোঝো! আমি তাকে হাত ধরে নিজের ঘরে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ফোন করতে ছুটলুম।
আমাকে কর্তা-গিন্নী এতদিন ধরে যে আদর-আপ্যায়ন করেছেন তার প্রতিদানে যদি সে-সন্ধ্যায় কর্তার বদলে আমি সিবিলাকে নিয়ে স্টেশনে না যেতুম তাহলে নিছক নিমকহারামি হত। হার্ট নিয়ে কর্তা আচ্ছন্নের মত পড়ে আছেন। আমি নার্সিংহোম যাচ্ছি শুনে আমার হাতে সিবিলার ছ’মাসের জমানো মাইনে দিলেন। গিন্নী নিজের থেকে আরো কিছু, আর আপন হাতে বোনা বাচ্চার জন্য একজোড়া মোজা দিলেন।
গোডেসবের্গ ছোট শহর। কিন্তু নার্সিংহোম থেকে স্টেশন যেতে হলে দুটি বড় রাস্তার উপর দিয়ে যেতে হয়। আমি স্টিয়ারিঙে, সিবিলা বাচ্চাকে নিয়ে পিছনে। ইচ্ছে করেই ড্রাইভারকে সঙ্গে নিইনি, এবং ট্রেনটাও বাছা হয়েছে রাত্রের, যাতে করে খামকা বেশি জানাজানি হয়। তার মাইনে তাকে দিয়েছি। মোজার মোড়ক যখন সে খুলল তখন আমি সে দিকে তাকাইনি।