জিরিয়েজুরিয়ে নেওয়ার পর আমি বললুম, এইবার চলুন, আপনাদের ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাক। তখন কর্তা গিন্নীকে ঠেলেন, গিন্নী কর্তাকে। বুঝতে পারলুম ছেলের অসুখে তারা এতই বিহুল হয়ে গিয়েছেন যে সামান্যতম কর্তব্যের সামনে দু’জনেই ঘাবড়ে যান—পাছে কোনো ভুল হয়ে যায়, পাছে তাতে করে ছেলের রোগ বেড়ে যায়।
যদি জানা না থাকত যে যক্ষ্মায় ভুগছে তাহলে আমি কার্লকে ওলিম্পিকের জন্য তৈরি হতে উপদেশ দিতুম। কী সুন্দর সুগঠিত দেহ—যেন গ্রীক ভাস্কর শাস্তু মিলিয়ে মেপেজুপে প্রত্যেকটি অঙ্গ নির্মাণ করেছেন, কোনো জায়গায় এতটুকু খুঁত ধরা পড়ে না। আর সানবাথ নিয়ে নিয়ে গায়ের রঙটি আমাদের দেশের হেমন্তের পাকাধানের রঙ ধরেছে, চোখ দুটি আমাদেরই শরতের আকাশের মতো গভীর আসমানি।
ঘরে আরেকটি প্রাণী উপস্থিত ছিল, নিতান্ত সাদামাটা চেহারা, কিন্তু স্বাস্থ্যবতী রোগীর নার্স। গিন্নী আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদেরই শহর স্টুটগার্টের মেয়ে, সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কার্লের সেবার ভাবনা আমাদের এতটুকুও ভাবতে হয় না। আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।
একে নিয়েই আমার অভিজ্ঞতা।
লেডি কিলার সরকার বলল, ‘কিন্তু বললেন যে নিতান্ত সাদামাটা?’
রায় বললেন, ‘চোপ!
চাচা কোনো কথায় কান না দিয়ে বললেন, অভিজ্ঞতাটা এমনি মর্মন্তুদ যে সেটা আমি চটপট বলে ফেলি। এ জিনিস ফেনিয়ে বলার নয়।
মেয়েটির নাম সিবিলা। প্রথম দর্শনে নার্সদের কায়দামাফিক গম্ভীর সরকারি চেহারা নিয়ে টেম্পারেচারের চার্টের দিকে এমনিভাবে তাকিয়েছিল, যেন চার্টখানা হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে যাবার চেষ্টা করলে সে সেটাকে খপ করে ধরে ফেলবে। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই টের পেলুম, সে কার্লকে যত না নিখুঁত সেবা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রাণরস যোগাচ্ছে হাসিখুশী, গালগল্প দিয়ে। সাদামাটা চেহারা কিন্তু সেটা যতক্ষণ সে অন্যের প্রতি উদাসীন ততক্ষণই-একবার কথা বলতে আরম্ভ করলে চোখমুখ যেন নাচতে থাকে, ড্যাবডেবে পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে-রকম ধারা হয়। কারো কথা শোেনার সময়ও এমনভাবে তাকায়, মনে হয় যেন চোখ দিয়ে কথা গিলছে। তার উপর গানের ফোয়ারা তার ছিল অন্তহীন—গ্যেটে, হাইনে, ম্যারিকে, কের্টের কথা, বেটোফেন, ব্রামস, শুমান, মেন্ডেলজোনের সুর দিয়ে গড়া যে-সব গান সে কখনো কার্সের জন্য চেঁচিয়ে, কখনো আপন মনে গুনগুনিয়ে গেয়েছে, তার অর্ধেক ভাণ্ডারও আমি অন্য কোনো এমেচারের গলায় শুনিনি।
কিন্তু কয়েকদিনের ভিতরেই লক্ষ্য করলুম, কথা বলার মাঝখানে সিবিলা আচমকা কেমনধারা আনমনা হয়ে যায়, খানার টেবিলে হঠাৎ ছুরিকাটা রেখে দিয়ে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, আর প্রায়ই দেখি অবসর সময়ে রাইনের পারে একা একা বসে ভাবছে। দু-একবার নিতান্ত পাশ ঘেঁষে চলে গিয়েছি—সিবিলা কিন্তু দেখতে পায়নি। ভাবলুম নিশ্চয় প্রেমে পড়েছে। কিন্তু কখন, আর কার সঙ্গে?
এমন সময় একদিন গিন্নী আমায় খাঁটি খবরটা দিলেন। ভদ্রমহিলা নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হয়েই আমাকে সব কিছু বললেন, কারণ তার স্বামী কার্লের অসুখের ব্যাপারে এমনি কাহিল হয়ে পড়েছিলেন যে গিন্নী খবরটা তার কাছে ভাঙতে সাহস পাচ্ছিলেন না।
সিবিলা অন্তঃসত্ত্বা এবং অবিবাহিতা। পাঁচমাস। আর বেশিদিন চলবে না। পাড়ায় কেলেঙ্কারি রটে যাবে।
আমার মস্তকে বজ্রাঘাত হয়নি। আমি গিন্নীকে বললুম, সিবিলা চলে গেলেই পারে।
গিন্নী বললেন, যাবে কোথায়, খাবে কী? এ-অবস্থায় চাকরী তো অসম্ভব, মাঝখান থেকে নার্সের সার্টিফিকেটটি যাবে।
আমি বললুম, তা হলে কর্তাকে না জানিয়ে উপায় নেই।
গিন্নীর আন্দাজ ভুল। কর্তা খবরটা শুনে দু’হাত দিয়ে মাথার চুল ছেঁড়েননি, রেগেমেগে চেল্লাচেল্লিও করেননি। প্রথম ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন, সিবিলার সঙ্গে খোলাখুলি কথাবার্তা না বলে উপায় নেই। কিন্তু আমি মনিব, সে কর্মচারী এবং ব্যাপারটা সঙ্গিন। আপনার মতো কেউ যদি মধ্যস্থ থাকে, তবে বড় উপকার হয়। অথচ জিনিসটা আপনার কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হবে বলে আপনাকে অনুরোধ করতে সাহস পাচ্ছি না।
আমি রাজি হলুম।
সিবিলা টেবিলের উপর মাথা রেখে অঝোরে কাঁদল। কর্তা-গিন্নী দু’জনই খাঁটি লোক, সিবিলাকে এ বিপদ থেকে কী করে উদ্ধার করা যায় তার উপায় অনুসন্ধান করলেন অনেক, কিন্তু বিশেষ কিছু ফল হল না। তার কারণটাও আমি বুঝতে পারলুম। একদিকে বিচক্ষণ সংসারী লোক পরিস্থিতিটা ঠাণ্ডা মাথায় কাবুতে আনার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে গ্যেটে-হাইনের স্নেহ-প্রেমের কবিতায় ভরা, অনুভূতির ভাপে-ঠাসা জালে-পড়া সবৎসা সচকিত হরিণী। ইনি বলছেন, ‘পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে জাল ছেঁড়ো। ও বলছে, ‘ছোঁড়াছুঁড়ি করলে বাচ্চা হয়তো জখম হবে। ইনি জিজ্ঞেস করছেন, বাচ্চার বাপ কে?’ ও মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বোঝাচ্ছে, ‘তাতে কোনো লাভ নেই। সে বিবাহিত ও অত্যন্ত গরীব।’
বুঝলুম, সিবিলার মনস্থির, সে মা হবেই।
কেঁদে কেঁদে টেবিলের একটা দিক ভিজিয়ে ফেলেছে।
চাচা স্পর্শকাতর বাঙালি, কাজেই তার গলায় বেদনার আভাস পেয়ে আড্ডার কেউই আশ্চর্য হল না।
চাচা বললেন, দেশে আমার বোন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বাড়ি ফিরেছে। মা খুশি, বাবা খুশি। দুদিন আগে নির্মমভাবে যে-বোনের চুল ছিঁড়েছি তার জন্যে তখন কাঁচা পেয়ারার সন্ধানে সারা দুপুর পাড়া চুষি। তার শরীরের বিশেষ যত্ন নেওয়ার কথা উঠলেই সে মিষ্টি হাসে—কী রকম লজ্জা, খুশি আর গর্বে মেশাননা। ছোট বোনরা কাঁথা সেলাই করে, আর বাবার বন্ধু বুড়ো কবরেজ মশায় দু’বেলা গলা খাঁকারি দিয়ে বাড়িতে ঢোকেন।