গহরজান যখন পানের পিক গিলতেন তখন নাকি গলার চামড়ার ভিতর দিয়ে তার লাল রঙ দেখা যেত। যে-রমণীকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম তার চামড়া, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুখচ্ছবি দেখে মনে হল তিনি যেন সকালবেলাকার শিশির দিয়ে গড়া। জর্মনিতে পান পাওয়া যায় না, কিন্তু আমার মনে হল ইনি পান খেলে নিশ্চয়ই পিকের রঙ এঁর গলার চামড়ায় ছোপ লাগাবে। চুল যেন রেশমের সুতো, ঠোঁট দুখানি যেন প্রজাপতির পাখা, ভুরু যেন উড়ে-যাওয়া পাখি, সসুদ্ধ মিলিয়ে মনে সন্দেহ হয় ইনি দাঁড়িয়ে আছেন না হাওয়ায় ভাসছেন। প্রথম দিনেই যে এ-সবকিছু লক্ষ্য করেছিলুম তা নয়। কিন্তু আজ যখন পিছনপানে তাকাই তখন তার ঐ চেহারাই মনে পড়ে।
ইংরিজিতে বোধহয় একেই বলে ডায়াফনাস। আস্বচ্ছ’ বললে ঠিক মানে ধরা পড়ে।
কতক্ষণ ধরে হাবার মতো তাকিয়েছিলুম জানিনে, হঠাৎ শুনলুম ‘গুটেন মর্গেন (সুপ্রভাত), আপনার আগমন শুভ হোক। আমি ফ্রাউ (মিসেস) ডুটেহফার।
ভাগ্যিস ভারি মালপত্র ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির হাতে আগেই সমঝে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তা না হলে মাল নিয়ে আমি বিপদে পড়তুম। এ রকম অবস্থায় চাকর-দাসী কেউ না কেউ আসে। কিন্তু কেউ যখন এল না তখন বুঝতে পারলুম ডুটেনহফারদের দুরবস্থা কতটা চরমে পৌঁচেছে।
প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ডজনখানেক হল পেরলুম—কোথাও একরত্তি ফার্নিচর নেই, দোজানলায় পর্দা পর্যন্ত নেই। দেয়ালের সারি সারি হুক দেখে বুঝলুম, এককালে নিশ্চয় বিস্তর ছবি ঝোলানো ছিল, মেঝের অবস্থা দেখে বুঝলুম এ-মেঝের উপর কখনো কোনো জুতোর চাট পড়েনি—জন্মের প্রথম দিন থেকে এর সর্বাঙ্গ গালচেতে ঢাকা ছিল। কঙ্কাল থেকে পূর্ণাবয়ব মানুষের যতখানি ধারণা করা যায়, দেয়ালের হুকের সার, ছাতের শেকলের গোছা, দরজা-জানলার গায়ে লাগানো পরদা-ঝোলানোর ডাণ্ডা থেকে আমি নাচের ঘর, মজলিসখানা, বাজিঘরের ততখানি আন্দাজ করলুম।।
শূন্য শোন ভয়ঙ্কর, কিন্তু কঙ্কালের ব্যঞ্জনা বীভৎস। এ-বাড়িতে থাকব কী করে? চুলোয় যাক প্রাশান জর্মন শেখা।
আন্দাজে বুঝলুম যে আমার জন্য যে-ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে সেটা বাড়ির প্রায় ঠিক মাঝখানে। ফ্রাউ ডুটেহফার আমাকে সে-ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে
গেলেন।
বজরার মতো খাট, কিন্তু ঘরখানাও বিলের মতো। নৌকোয় চড়া অভ্যাস না হওয়া পর্যন্ত বিলের মাঝখানে নৌকোয় ঘুমুতে যে-রকম অসহায় অসহায়, কঁকা ফাঁকা ঠেকে, সে-খাটে শুয়ে আমারো সেই অবস্থা হয়েছিল।
দুপুরে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি বেকুয়েট টেবিলে তিনজনের জায়গা। টেবিলের এক মাথায় কর্তা, অন্য মাথায় গিন্নী, মাঝখানে আমি। একে অন্যকে কোনো জিনিস হাত বাড়িয়ে দেবার উপায় নেই বলে তিনজনের সামনেই আপন আপন নিমক-দান। মাস্টার্ড, সস মাথায় থাকুন, গোলমরিচেরও সন্ধান নেই। বুঝলুম পাঁড় প্রাশানের বাড়ি বটে। আড়ম্বরহীনতায় এদের রান্নার সামনে আমাদের বালবিধবার হবিষ্যান্নও লজ্জায় ঘোমটা টানে। কিন্তু ওসব কথা থাক, এরকম ধারা মশলার বিরুদ্ধে জেহাদ আমি অন্য জায়গায়ও দেখেছি।
ভেবেছিলুম বাড়ির কর্তাকে দেখতে পাব শুয়োরের মতো হোঁকা, টমাটোর মতো লাল, অসুরের মতো চেহারা, দুষমনের মতো এই-মারি-কি-তেই-মারি—অর্থাৎ সবসুদ্ধ জড়িয়ে-মড়িয়ে প্রাশান বিভীষিকা। কিন্তু যা দেখলুম তার সঙ্গে তুলনা হয় তেমন কিছু ইয়োরোপে নেই।
এ যেন নর্মদা-পারের সন্ন্যাসী বিলিতি কাপড় পরে পদ্মাসনে না বসে চেয়ারে বসেছেন। দেহের উত্তমার্ধ কিন্তু যোগাসনে—শিরদাঁড়া খাড়া, চেয়ারে হেলান দেননি।
শীর্ণ দীর্ঘ দেহ, শুষ্ক মুখ, আর সেই শুকনো মুখ আরো পাংশু করে দিয়েছে দুখানি বেগুনি ঠোঁট। কপাল থেকে নাক নেমে এসেছ সোজা, চশমার ব্রিজের জায়গায় এতটুকু খাঁজ খায়নি, আর গালের হাড় বেরিয়ে এসে চোখের কোটর দুটোকে করে দিয়েছে গভীর গুহার মতো। কিন্তু কী চোখ! আমার মনে হল উঁচু পাহাড় থেকে তাকিয়ে দেখছি নীচে, চতুর্দিকে পাথরে ঘেরা নীল সরোবর। কী গভীর, কী তরল! সে-চোখে যেন এতটুকু লুকোনো জিনিস নেই। যত বড় অবিশ্বাস্য কথাই এ লোকটা বলুক না কেন, এর চোখের দিকে তাকিয়ে সে কথা অবিশ্বাস করার জো নেই।
খেতে খেতে সমস্তক্ষণ আড়-নয়নে সেই ধ্যানমগ্ন চোখের দিকে, সেই বিষণ্ণ ঠোঁটের দিকে আর চিন্তাপীড়িত ললাটের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখছি। তখন চোখে পড়ল তার খাবার ধরন। চোয়াল নড়ছে না, ঠোঁট নড়ছে না, খাবার গেলার সময় গলায় সামান্যতম কম্পনের চিহ্ন নেই।
পরনে প্রাশান অফিসারদের যুনিফর্ম তো নয়ই, মাথার চুলও কদম-ছাঁট নয়। ব্যাব্রাশ করা চকচকে প্ল্যাটিনামব্লন্ড চুল।
কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় মনে হল এঁর বয়স। চল্লিশ, পঞ্চাশ, সত্তর হতেও বাধা নেই। বয়সের আন্দাজ করতে গিয়েই বুঝলুম নর্মদা-পারের সন্ন্যাসীর সঙ্গে এঁর আসল মিল কোনখানে।
এত অল্প খেয়ে মানুষ বাঁচে কী করে, তাও আবার শীতের দেশে? সুপ খেলেন না, পুডিং খেলেন না, খাবার মধ্যে খেলেন এক টুকরো মাংসশ্যামবাজারের মামুলি মটনকটলেটের সাইজ—দুটো সেদ্ধ আলু, তিনখানা বাঁধাকপির পাতা আর এক স্লাইস রুটি। সঙ্গে ওয়াইন, বিয়ার, জল পর্যন্ত না!
আহারে যত না বিরাগ তার চেয়েও তার বেশি বিরাগ দেখলুম বাক্যালাপে। নতুন বাড়িতে উঠলে প্রথম লাঞ্চের সময় যে-সব গতানুগতিক সম্বর্ধনা, হাসিঠাট্টা, গ্যাস সম্বন্ধে সতর্কতা, সিঁড়ির পিচ্ছিলতা সম্বন্ধে খবরদারি সে-সব তো কিছুই হল না—আমি আশাও করিনি—আবহাওয়া সম্বন্ধে মন্তব্য, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ভদ্রতা-দুরস্ত কৌতূহল, এ সব কোনো মন্তব্য বা প্রশ্নের দিক দিয়ে হের ওবের্স্ট কর্নেল মহাশয়) গেলেন না। আমিও চুপ করে ছিলুম, কারণ আমি বয়সে সকলের ছোট।