চাচা বললেন, কী করে বর্ণসঙ্কর হয়, আর তার ফল কী, সেটা প্রথম অধ্যায়ে বেশ ধাপে ধাপে বাৎলানো হয়েছে, না রে? বলতো, ধাপগুলো কী?
শ্রীধর খাবি খাচ্ছে দেখে আড্ডার পয়লা নম্বরের আড্ডাবাজ পুলিন সরকার বলল, কুলক্ষয় থেকে কুলধনষ্ট, কুলধনষ্ট থেকে অধর্ম, অধর্ম থেকে স্ত্রীলোকদের ভিতর নষ্টামি, নষ্টামি থেকে বর্ণসঙ্কর, বর্ণসঙ্কর হলে পিতৃপুরুষের পিণ্ডলোপ–
মুখুয্যে বাধা দিয়ে বলল, ‘হাঁ, হাঁ, প্রফেসর বলছিল, ‘পিণ্ডির পরোয়া করে কোন সুস্থবৃদ্ধির লোক’?
বিয়ারের ভিতর থেকে সূয্যি রায়ের গলা বুদ্বুদের মতো বেরলো, ‘ছোকরা প্রফেসর ঠিক বলেছে। বর্ণসঙ্কর ভালো জিনিস। মুখুয্যে বামুনের ছেলে, এদিকে গীতার পয়লা পাঠ মুখস্থ নেই। সরকার কায়েতের ছেলে, পুরো চেনটা বাৎলে দিলে। মুখুয্যের উচিত সরকারের মেয়েকে বিয়ে করে কুলধর্ম বাঁচাননা।
চাচা বললেন, ঠিক বলেছ, রায়। তাহলে তুমি এক কাজ কর। তোমার বিয়ারে একটু জল মিশিয়ে ওটাকে বর্ণসঙ্কর করে ফেলল।
রায় রীতিমতো শকড হয়ে বললেন, ‘পানশাস্ত্রে এর চেয়ে বড় নাস্তিকতা আর কিছুই হতে পারে না। বিয়ারে জল!
চাচা মুখুয্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোদের নয়া প্রফেসরটা নিশ্চয়ই ইহুদি। ওরা যেমন প্রাণপণ চেষ্টা করে আপন জাতটাকে খাঁটি রাখবার জন্য, ঠিক তেমনি আর পাঁচজনকে উপদেশ দেয় বর্ণসঙ্কর ডেকে আনবার জন্য। ওদিকে খাঁটি জর্মন এ সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করে না একদম, কিন্তু কাজের বেলায় না খেয়ে মরবে তবু বর্ণসঙ্কর হতে দেবে না।’
সরকার জিজ্ঞেস করল, ‘এদেশেও নির-উপবাস আছে কি? চাচা বললেন, আলবাৎ! শোন। আমি এ-বিষয়ে ওকবহাল। ‘পয়লা বিশ্বযুদ্ধের পর হেথায় অবস্থা হয়েছিল জর্মনির সর্বনাশ, বিদেশীর পৌষ মাস। ইনফ্লেশনের গ্যাসে ভর্তি জর্মন কারেন্সির বেলুন তখন বেহেশতে গিয়ে পৌঁচেছে—বেহেশতটা অবশ্যি বিদেশীদের জন্য, জর্মনরা কেউ পাঁচ হাজার, কেউ দশ হাজারে বেলুন থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। আত্মহত্যার খবর তখন আর কোনো কাগজ ছাপাত না, নারী-হৃদয় ইকনমিক্সের কমডিটি, এক বার’ চকলেট দিয়ে একসার ব্লন্ড কেনা যেত, পাঁচটাকায় ফার’ কোট, পাঁচশ’ টাকায় কুরফুর্স্টেনডামমে বাড়ি, এক টাকায় গ্যেটের কমপ্লীট ওয়ার্কস।
আড্ডার সবাই সেই সর্বনাশী পৌষ মাসের কথা ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
চাচা বললেন, ‘সেই ঝড়ে তখনো যে সব বাড়ি দড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল তাদের প্রত্যেকের ভিতরে ছিল বিদেশী পেয়িং-গেস্ট। যেসব জর্মন পরিবারে বিদেশীরা পেয়িং-গেস্ট হয়ে বসবাস করছিল তাদের প্রায় সকলেই খেয়েপরে জান বাঁচাতে পেরেছিল, কারণ যত নির্লজ্জ, কঞ্জুস, সুবিধাবাদী, পৌষ-মাসীই হও না কেন, তামাম মাসের ঘরভাড়া, খাইখর্চার জন্য অন্তত পঞ্চাশটি টাকা তো দিতে হয়। বিদেশী টাকার তখন এমনি গরমী যে সেই পঞ্চাশ টাকায় তোমাকে নিয়ে একটা পরিবারের কায়ক্লেশে দিনগুজরান হয়ে যেত।
গোঁসাই গুনগুন করে গান ধরলেন, ‘দেখা হইল না রে শ্যাম, তোমার সেই নতুন বয়সের কালে।
চাচা বললেন, কিন্তু একটা দেশের দুর্দিনে এক সের ধান দিয়ে পাঁচ সের চাল নিতে আমার বাধত। তাই যখন আমার বুড়ো ল্যান্ডলেডি একদিন হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেল তখন আমাকে লুফে নেবার জন্য পাড়ায় কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। এমন সময় আমার বাড়িতে একদিন এসে হাজির ফ্রলাইন ক্লারা ফন্ ব্ৰাখেল।
আচ্ছা একগলায় শুধাল, হকি-টিমের কাপ্তান?
চাচা বললেন, আমার জান-বাঁচানেওয়ালী। বললেন, ‘ক্লাইনার ইডিয়োট (হাবাগঙ্গারাম), তুমি যদি অন্য কোথাও না গিয়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠো তা হলে আমি বড় খুশি হই। প্রাশান ওবের্স্টের (কর্নেলের) বাড়ি, একটু সাবধানে চলতে হবে। এককালে খুব বড়লোক ছিলেন, এখন ‘উজর টেগলিষে ব্রো গি উত্স হয়টে (Give us this day our daily bread)। অথচ এমন দম্ভী যে পেয়িং-গেস্টের কথা তোলাতে আমাকে কোর্ট-মার্শাল করতে চান। শেষটায় যখন বললুম যে তুমি প্রাশান কারো কাছ থেকে উচ্চাঙ্গের জর্মন শেখার জন্য সুদূর ভারতবর্ষ থেকে বার্লিন এসেছ, তখন ভদ্রলোক মোলায়েম হন। এখন বুঝতে পারছ, কেন তোমাকে সাবধানে পা ফেলতে বললুম। তুমি ভাবটা দেখাবে যেন তার বাড়িতে উঠতে পেরে কৃতার্থম্মন্য হায়েছ। তুমি যে কোনো উপকার করছ সেটা যেন ধরতে না পারেন। তার বউ সম্বন্ধে কোনো দুর্ভাবনা কোরো না। তিনি সব বোঝেন, জানেন।’
চাচা বললেন, ‘প্রাশান অফিসারদের আমি চিরকাল এড়িয়ে গিয়েছি। দূর থেকে ব্যাটাদের ধোপদুরস্ত ইস্ত্রি করা স্টিফ ইউনিফর্ম আর স্টিফ ভাবসাব দেখে আমার সব সময় মনে হয়েছে এরা যেন হাসপাতালের এপ্রন-পরা সার্জেনদের দল। সার্জেনরা কাটে নির্বিকার চিত্তে রোগীর পেট, এরা কাটে পরমানন্দে ফ্রান্সের গলা।।
চাচা বললেন, কিন্তু ফন্ ব্রাথেলের প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা ছিল তার দৌলতে আমি অনেক কিছুই করতে প্রস্তুত ছিলুম। এবং মনে মনে ভাবলুম বেশির ভাগ ভারতীয়ই বসবাস করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে, দেখাই যাক না খানদানীরা থাকে কী কায়দায়।
ফন্ ব্ৰাখেল আমাকে নিয়ে যাননি। খবর দিয়ে আমি একাই একদিন সুটকেস নিয়ে কর্নেল ডুটেহফারের বাড়ি পৌঁছলুম।
ট্যাক্সিওলা যে বাড়ির সামনে দাঁড়াল তার চেহারা আগে দেখা থাকলে ফন্ ব্রাথেলের প্রস্তাবে আমি রাজি হতুম কি না সন্দেহ। বাড়ি তো নয়, সে এক রাজপ্রাসাদ। এ বাড়িতে তো অন্তত শ’খানেক লোকের থাকার কথা। কিন্তু তাকিয়ে দেখি দোতলার মাত্র দুতিনখানা ঘরের জানলা খোলা, বাদবাকি যেন সিল মেরে আঁটা। সামনে প্রকাণ্ড লন। পেরিয়ে গিয়ে দরজার ঘন্টা বাজালুম। মিনিটতিনেক পরে যখন ভাবছি আবার ঘন্টা বাজাবো কি না তখন দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল।