বললুম, ‘আজ তা হলে থাক না। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। কোথায় থাকেন বলুন তো?’
‘কাছেই, আভনীর হোটেলের পাশের গলিতে।’
খুশি হয়ে বললুম, ‘তা হলে চলুন, আমি আভনীরেই থাকি।’
রাস্তায় চলতে চলতে সে আমার বাহু চেপে ধরল। হাতের আঙুল কোনো ভাষায় কথা বলে না বলেই সে অনেক কথা বলতে পারে। তার কিছুটা বুঝলুম, কিছুটা বুঝেও বুঝতে চাইলুম না। হঠাৎ মেয়েটার কেমন যেন মুখ খুলে গেল। বোধ হয় সেরাত্রে ‘ব সোয়ার’ বলার বিভীষিকা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলে। বলতে লাগল, পয়সা রোজগারের কত চেষ্টা সে করেছে, কত চাকরি সে পেয়েছে, তারপর যারা চাকরি দিয়েছে তারা কী চেয়েছে, কী রকম জোর করেছে, সে পালিয়েছে, আরো কত কী।
আর কী অদ্ভুত সুন্দর ফরাসী ভাষা! থাকতে না পেরে বাধা দিয়ে বললুম, আপনি এত সুন্দর ফরাসী বলেন!
ভারি খুশি হয়ে গর্ব করে বলল, বাঃ, দোদে পরিবারের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল যে।
তাই বলল। আলস দোদের মতো কটা লোক ফরাসী লিখতে পেরেছে।
হোটেল পৌঁছতে পৌঁছতে সে অনেক কথা বলে ফেলল।
হোটেলে পেরিয়ে মেয়েটির বাড়ি যেতে হয়। দরজার সামনে সে দাঁড়াল। আমি বললুম, চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। বলল, না। আমি বললুম ‘সে কী? উত্তর না পেয়ে বললুম, তা হলে বন্ নই—শুভরাত্রি—তুমি এইটুকু একাই যেতে পারবে।
শেকহ্যান্ড করার জন্য তার হাত ধরেছিলুম। সে হাত ছাড়লো না। মাথা নীচু করে বলল, তুমি আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে চলো।
আমাকে বোকা বলুন, মেয়েটিকে ফন্দিবাজ বলুন, যা আপনাদের খুশি, কিন্তু আমার ধর্মসাক্ষী, আমি তাকে খারাপ বলে কিছুতেই স্বীকার করে নিতে পারলুম না। বললুম, ‘আমার সামর্থ্য নেই যে তোমাকে সত্যিকার সাহায্য করতে পারি, কিন্তু তোমাকে ভগবান যে সৌন্দর্য দিয়েছেন তাকে বাঁচাতে পারলে যেকোনো লোক ধন্য হবে। ভগবান’ শব্দটা প্যারিসের পথে বড় বেখাপ্পা শোনালো।
মেয়েটি মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললুম, কী হবে বৃথা উপদেশ দিয়ে। তুমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছ।
আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল। ডাগর ডাগর দু চোখ আমাকে কী বলল সে কথা আজও ভুলিনি। আমার দিকে ও-রকম করে আর কেউ কখনো তাকায়নি।
তারপর আস্তে আস্তে সে আপন বাড়ির দিকে রওয়ানা হল।
আমি মুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখলুম, তার সমস্ত দেহটি আপন অসীম সৌন্দর্য বহন করে চলেছে রাজরানীর মতো সোজা হয়ে, আর মাথাটি ঝুঁকে পড়েছে বেদনা আর ক্লান্তির ভারে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই মনে হল, ভুল করেছি। মানুষ সাহায্য করতে চাইলে সর্বাবস্থায়ই সাহায্য করতে পারে। নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল, এত সোজা কথাটা কাল রাত্রে বুঝতে পারলুম না কেন।
তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে মেয়েটিরকী মূখ আমি, নামটি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করিনি. সন্ধানে বেরুতে যাবার মুখে হোটেলের পোর্টার আমাকে একটি ছোট পুলিন্দা দিল।
খুলতেই একখানা চিঠি পেলুম:
‘বন্ধু, তোমার কথাই মেনে নিলুম। আজ পাঁচটার ট্রেনে আমি গ্রামে চললুম। সেখানেও আমার কেউ নেই। তবু উপবাসে মরা প্যারিসের চেয়ে সেখানেই সহজ হবে। বিনা টিকিটেই যাচ্ছি।।
তোমাকে দেবার মতো আমার কিছু নেই, এই সুয়েটারটি ছাড়া। ভগবানেরই দয়া, তোমার গায়ে এটা হবে।
জ্যুলি’
বিধবা-বিবাহ
আমাদের পুজোসংখ্যা ইংরেজদের ক্রিসমাস স্পেশালের অনুকরণে জন্মলাভ করেছিল কি না সে-কথা পণ্ডিতেরা বলতে পারবেন, কিন্তু একথা ঠিক যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে ইংরিজি স্পেশালের চেয়ে অনেক বেশি তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাচ্ছে। ক্রিসমাস সংখ্যাগুলোতে থাকে অসংখ্য ছেলেমানুষি গল্প আর এন্তার গাঁজা-বছরের আর এগারো মাস ইংরেজ হাঁড়িপানা মুখ করে থাকে বলে ঐ একটা মাস সে মুখের সব লাগাম ছিঁড়ে ফেলে যা-খুশি-তাই বকে নেয়। আমাদের পুজোসংখ্যায় এ-সব পাগলামি থাকে না। তাই ভেবে পাইনে সত্যি-মিথ্যেয় মেশানো এদেশের আজগুবি গল্পগুলো ঠাঁই পাবে কোথায়, কোন মোকায়?
এতদিন ইংরেজের নকল করতে বাধো বাধো ঠেকত। ভয় হত পাছে লোকে ভাবে ‘খানবাহাদুরির তালে আছি। এখন পুজোর গাঁজায় দম দিয়ে দু’চারখানা গুল ছাড়তে আর কোনো প্রকারের বাধা না থাকারই কথা। অবশ্য সত্যি-মিথ্যের মেকদার যাচাইয়ের জন্য পাঠক জিম্মাদার।
বরোদার ভূতপূর্ব মহারাজা তৃতীয় সয়াজী রাও-এর কথা এদেশের অনেকেই জানেন। ইনি বিলেত থেকে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ, মৌলানা মুহম্মদ আলীকে এবং এদেশ থেকে রমেশচন্দ্র দত্ত ও শ্ৰীযুত আম্বেডকরকে বেছে নিয়ে বরোদার উন্নতির জন্য নিয়োগ করেন। এককালে প্রবাসীতে এর সম্বন্ধে অনেক লেখা বেরিয়েছিল। বরোদা রাজ্যের দু-একজন বৃদ্ধের মুখে আমি শুনেছি, অরবিন্দ বাঙলাদেশে যে আন্দোলন আরম্ভ করেন তাতে নাকি সয়াজী রাও-এর গোপন সাহায্য ছিল।
ইনি আসলে রাখাল-ছেলে। বরোদার শেষ মহারাজা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে গদিচ্যুত হলে পর, ইনি তার নিকটতম আত্মীয় বলে এঁকে দূর মহারাষ্ট্রের মাঠ থেকে ধরে এনে গুজরাতের বরোদা রাজ্যের গদিতে বসানো হয়। তখন তার বয়স যোলর কাছাকাছি। বরোদার তখন এমনি দুরবস্থা যে দিবা-দ্বিপ্রহরে নেকড়ে বাঘ শহরের আশপাশ থেকে মানুষের বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত–সরকারী চাকুরেদের বছরতিনেকের মাইনে বাকি থাকতে বলে দেশটা চলতো ঘুষের উপর, আর তাবৎ বরোদা স্টেটের ঋণ নাকি ছিল ত্রিশ কোটি টাকার মতো।