ভারতবর্ষের হিন্দু মূর্খ, সে কাশী যায়, মুসলমান মূখ, সে মক্কা যায়। ইয়োরোপীয় সংযমী মাত্রই অমৃতের সন্ধানে প্যারিস যায়।
প্যারিসে নিশাভাগে নারীবর্জিতাবস্থায় চলনে পদে পদে বনিতাধরপল্লব থেকে আপনার কর্ণকুহরে অমৃত প্রবেশ করবে, ‘বঁ সোয়ার মসিয়োঁ—আপনার সন্ধ্যা শুভ হোক। আপনি যদি সে ডাকে সাড়া দেন, তবে—তবে কী হয় না হয় সে সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার নেই, প্রয়োজনও নেই, এমিল জোলার মলিনাথও আমি হতে চাইনে। শরৎ চাটুয্যে যা লিখেছেন, তা আমার এখনও হজম হয়নি।
হোটেল আর বেশি দূরে নয়—মহড়াটা ঈষৎ নির্জন হয়ে আসছে। হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলুম, তাই আপন অজানতে একটা ব সোয়ারের উত্তর দিয়েই বুঝতে পারলুম ভুল করে ফেলেছি। এক সন্ধ্যায় দুই সুন্দরী সামলাননা আমার কর্ম নয়। আমার পূর্বপুরুষগণ একসঙ্গে চার সুন্দরী সামলাতে পারতেন। হায়, আমার অধঃপাত কতই গগনচুম্বী থেকে কতই অতলস্পর্শী!
নাঃ, এঁর বেশভূষা দেখে মনে তো হচ্ছে না ইনি বসন্তসেনার সহোদরা, যদিও দরিদ্র চারুদত্ত আমি নিশ্চয়ই বটি। এ রকম নিখুত সুন্দরী রাস্তায় বেরুবেন্স কেন? তবে হাঁ, তুলসীদাস বলেছেন, সংসার কী অদ্ভুত রীতিতে চলে দেখ, শুড়ি দোকানে বসে বসে মদ বিক্রয় করে, সেখানে ভিড়েরও অত নেই, আর বেচারি দুধওলাকে ঘরে ঘরে ফেরি দিয়ে দিয়ে দুধ বিক্রয় করতে হয়। কিন্তু এ নীতি তো হেথায় খাটে না।
আমি বললুম, অপরাধ নেবেন না, কিন্তু আপনাকে ঠিক প্লেস করতে পারছিনে।
সুন্দরী স্মিত হাস্য করলেন, বীণার পয়লা পিড়িঙের মতো একটা ধ্বনিও বেরুল। সে-হাসি এতই লাজুক আর মিঠা যে তখুনি চিনতে পারলুম যে এঁকে আমি চিনিনে। এরকম হাসি অতি বড় অরসিকও একবার দেখলে ভুলতে পারে না।
কী করি, এ যে আবার আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। এসুহাসিনী রসের হাটের বসন্তসেনা নিশ্চয়ই নয়, তবে এরকম গায়ে পড়ে আলাপ করল কেন? আর ভালো-মন্দ কোনো কিছু বলছেই বা না কেন? এ কী রহস্য! নাঃ, কালই প্যারিস ছাড়ব। ক্রসওয়ার্ড আমি কাগজেই পছন্দ করি, জীবনে নয়।
হঠাৎ হোঁচট খেয়ে বেচারি পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি তাকে তুলে ধরলুম। শুধালুম, কী হয়েছে?’ বলল, রাস্তার দোষ নয়, আমি বড্ড ক্লান্ত।
আমি জানি আমার পাঠকরা আমাকে আর ক্ষমা করবেন না, বলবেন, ‘ওরে হস্তীমুখ, এক সন্ধ্যায় দু-দুবার ইত্যাদি। তবু স্বীকার করছি আমি আবার সেই আহাম্মকিই করলুম। কিন্তু এবার সোজাসুজি, প্যারিস-লঙ্গৌকে তিন-তালাক দিয়ে। বললুম, আমার কাছে আছে তিনটে কফি, একটা স্যানডুইচ আর পাচটি সিগারেটের দাম। কোনো কাফেতে গিয়ে একটু জিরোবেন?
বলল, আমি শুধু কফি খাব।
কাফেতে বসিয়ে বললুম, কফি-স্যানডুইচ খেয়ে বাড়ি যান।
কিছু বলল না, আপত্তি জানালো না।
কাফেতে কড়া আলোতে মেয়েটির চেহারা দেখে মনে হল এর দুর্বলতা না খেতে পেয়ে।
প্রেম অন্ধ কিন্তু প্যারিস তো প্রেমিক নয়। তবে সে এ-সুন্দরীকে উপোস করতে দিচ্ছে কেন? কিন্তু সে রহস্য সমাধানের জন্য একে প্রশ্ন করা বর্বরতা তো বটেই, তাই নিয়ে আপন মনে তোলপাড় করাও অনুচিত। পৃথিবীর অনাহার ঘোচাবার দাওয়াই যখন আমার হাতে নেই তখন রোগের কারণ জেনে কী হবে?
হঠাৎ মেয়েটি বলল, তুমি ভুল বুঝেছ, আমি বে—
আমি বললুম, চুপ, আমি কিছু শুনতে চাইনে।
বলল, তাই vous (আপনি) না বলে tu (তুমি) বললুম। তবে নতুন নেবেছি। কাল রাত্রে প্রথম। কিন্তু কেউ আমার কাছে ঘেঁষল না সাহস করে, আমার চেহারা তো ওরকম নয় আমি জানি। আমিও কাউকে সাহস করে ‘ব সোয়ার’ বলে নিমন্ত্রণ করতে পারিনি।
মানুষের দম্ভের সীমা নেই। স্থির করেছিলুম কোনো প্রশ্ন শুধাব না, তবু নিজের কথা জানতে ইচ্ছে করল। বললুম, আজ আমাকেই কেন ‘ব সোয়ার’ বললেন?
‘বোধ হয় বিদেশী–না, কী জানি কেন। ঠিক বলতে পারব না।’
আমি বললুম, ‘থাক, আমি সত্যি কিছু শুনতে চাইনে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু আজ রাত্রে যে করেই হোক আমাকে খদ্দের যোগাড় করতেই হবে। আজ সকালেই ল্যান্ডলেডি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল।
রাত ঘনিয়ে আসছে, আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল, আপনি বাড়ি যান আর নাই যান, আমার সঙ্গে বসে থাকলে তো আপনার! জানেন তো, পুরুষের সঙ্গে বসে আছেন দেখলে কেউ আপনার কাছে আসবে না। রাতও অনেক হয়েছে। এখন মাতালের সংখ্যা বেড়েই চলবে।
কেঁপে ওঠেনি, কিন্তু তার মুখোনি একটু বিকৃত হল।
কোনো কথা কয় না। বড় বিপদে পড়লুম, বললুম, ‘আমি তা হলে উঠি?’ বলল, ‘কেন? আমার সঙ্গে বসতে চাও না?’
আমি তাড়াতাড়ি মাপ চেয়ে বললুম, না, না, তা নয়। আপনাকে সত্যি বলছি। কিন্তু আমার সঙ্গে বসে থাকলে আপনার সময় যে বৃথায় যাবে।
বলল, তুমি আমাকে কফি খাওয়ালে।
কাতর হয়ে বললুম, প্লীজ, জিনিসটা ওরকম ধারা নেবেন না।
‘তা হলে তুমি আমাকে কফি খাওয়ালে কেন?
আমি বললুম, ‘প্লীজ, প্লীজ, এসব কথা বাদ দিন।’
বলল, ‘কেউ তো খাওয়ায় না। না, তুমি বসো। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার সত্যি ভালো লাগছে।’
এই দুঃখ-বেদনার মাঝখানেও এর সাহচর্য, সৌন্দর্য যে আমাকে টানছিল সে কথা অস্বীকার করে আপন দাম বাড়াতে চাইনে।
বলল, আর জানো, তুমি চুলে গেলেই আমাকে ‘ব সোয়ারের’ পাত্র খুঁজতে বেরুতে হবে। আমি আর সাহস পাচ্ছিনে।
হায় অরক্ষণীয়া, তুমি কী করে জানলে প্যারিস কত রূঢ় কত নিষ্ঠুর।